মেঘনার সুপরিচিত সাহিত্যিক পিয়ারা বেগম নিজ গ্রাম ভাওরখোলার স্নেহসিক্ত।

মেঘনা
মেঘনার সুপরিচিত সাহিত্যিক পিয়ারা বেগম নিজ গ্রাম ভাওরখোলার স্নেহসিক্ত।

আমাদের পারিবারিক মিলনমেলায়,
নিজের গ্রাম ভাওরখোলায়।
একঘেয়েমি জীবনাচারে আর যাই হোক পারিবারিক সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব হয় না তার জন্য চাই মাঝে-মধ্যে পারিবারিক মিলনমেলা! আর তা যদি হয় নিজের পৈতৃক বাস্তুভিটেয় তবে তো কথাই নেই!!ফেলে আসা অতীতকে জীবন্ত করে বর্তমান কর্মব্যস্ততার ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দিতে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে মধুর-শৈশবস্মৃতি রোমন্থন। মূলত নিজেদের পলাতক শৈশবের পলেস্তারার দুর্ভেদ্য আস্তরণ ঝেড়ে-মুছে স্মৃতিচারণায় প্রাণভরে উপভোগ করা যায় আর অন্যদিকে নতুন প্রজন্মদেরকে তাদের শেকড়ের সাথে পরিচিতির মিলনমেলাটাও চমকপ্রদ নান্দনিকতার আবহে উপভোগ্য এবং প্রাণবন্ত করে তোলা যায়। উল্লেখ্য যে, মিলনমেলার আরো একটা আকর্ষণ ছিল। মেজো ভাইয়ের একমাত্র ছেলে ফয়সাল মাহমুূদ পান্নার স্ত্রী শ্যামলী ইসলাম, একমাত্র বোনের ছেলে ডাঃ ফরহাদুর রেজা নয়নের স্ত্রী ডাঃ তাজরিন ফারহানা এই দুইজন নতুন বউকে এই প্রথম আমাদের গ্রামের বাড়িতে বরণ করা।


তাছাড়া, পরিবারের নতুন প্রজন্মরা যদি তাদের শেকড়কে না জানে, নিজের পারিবারিক চিরায়ত অতীত-ঐতিহ্য, সভ্যতা-ভব্যতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না রাখে, পুরোপুরি ওয়াকিবহাল না থাকে মূলত এ সবের প্রতি নিজ থেকে তাদের শ্রদ্ধাবোধ না জন্মে তবে তাদের জন্মগত সত্তা, তাদের অস্তিত্বকে একদিন তারা হয় তো অস্বীকার করবে। তাই গ্রামীণ ধান্য-সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা সহজাত বাঙালিয়ানা আচার-আচারণে অভ্যস্ত তাদের পূর্বপুরুষদের জীবনদর্শন সবকিছুর সাথেই তাদের প্রত্যক্ষ আত্মিক ও মানবিক যোগাযোগ রক্ষা করার প্রয়োজন। এ সব দেখেই তাদের পারস্পারিক সহমর্মিতা, মায়া- মমতা,স্নেহ-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠবে। তাদের স্বাভাবিক বিকাশটা হবে শাশ্বত ও চিরায়ত, পারিবারিক প্রচলিত প্রথাসিদ্ধ ও বিশ্বজনীন মমতার নির্যাসে আপাদমস্তক-মোড়া।

সেই লক্ষ্যে গত ২৬ এপ্রিল শুক্রবার এক অলোকসুন্দর এবং আনন্দঘন পরিবেশে মেঘনা উপজেলা ভাওরখোলা গ্রামে “জোবেদা খাতুন ভিলায়” আমাদের পারিবারিক মিলনমেলা পর্বটি উদযাপন করি। এতে স্বনামধন্য নিমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের উপস্থিতি আমাদের আনন্দটাকে আরো শতগুণে উপভোগ্য এবং প্রাণপ্রাচুর্যে, উৎসব- মাধুর্যে, হাস্য-কলরবে উল্লসিত ও নান্দনিকতায় মুখরিত করে রাখে। যাঁদের উপস্থিতি আমাদেরকে কৃতার্থ করেছে তাঁরা হলেন, আমাদের পরিবারের সবার বড় ভায়েস্তী রেহানা পারভীনের স্বামী আবদুর রইছ কাইজার, ট্রাস্টি অব ফেনী ইউনিভার্সিটি। সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন বড় ভায়েস্তা কামরুজ্জামান রতনের সম্বন্ধী জনাব মোজাম্মল হক, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অবঃ) পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং একমাত্র ভাগ্নে ডাঃ ফরহাদুর রেজা নয়নের শ্বশুর ডাঃ দিদারুল আলম, সিনিয়র কনসালটেন্ট হৃদরোগ বিভাগ, সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল ঢাকা। আমার ভগ্নীপতি কৃষিবিদ মোঃ আবদুল বাতেন পরিচালক (অবঃ) এবং আমার স্বামী জনাব মোঃ আবদুর রহিম ভূইয়াও উপস্থিত ছিলেন। সদ্য প্রয়াত বড় ভাবীর অবর্তমানে মেজো ভাইজান মোঃ সুরুযযামান পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবক হিসাবে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তাছাড়া ছোট ভাইজান কৃষিবিদ মোঃ মুরাদ হোসেন এবং বড় ভায়েস্তা কামরুজ্জামান রতন আনুষাঙ্গিক অর্পিত দায়িত্ব পালনে তৎপর ছিলেন সার্বক্ষণিক। ছোট বোন শামছুন নাহার, মেজো ভাবী, ছোট ভাবী, পারভীন, নাছরীন, হীরা,পান্না, ফুয়াদ, বড় বউ ইভা আর ছোট বউ আন্নি এবং ফারিয়া তাদের দায়িত্ব পালনে ছিল আন্তরিক। তাছাড়া আমার চাচাত বোন মমতাজ আপা তাঁর কোন তুলনাই নেই। শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্তেও আপা ২৪ তারিখ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত মাতৃস্নেহে আমাদের সব বিষয়ে তদারকি করেন। আপার জন্য আমাদের কোন সমস্যাই মোকাবেলা করতে হয় নি। আপা, তুমি দীর্ঘজীবী হও!

আনন্দ করেছি অনেক অনেক। খাওয়ার সময় আনন্দ, রাতে ফ্লোরিং করে শোয়া, গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা, কৌতুক, হাসি-তামাশা আলোচনা, ভুলধরা, খুনসুটি কোনটাই বাদ ছিলনা। তবে ভাগ্যিস ছোট ভাইজান মোঃ মুরাদ হোসেন রাতে জেনেরেটরের ব্যবস্থা করেছিলেন নতুবা আনন্দের স্বাদ রসাতলে যেত।

ব্যস্ততায়, ক্লান্তিতেও গ্রাম সংলগ্ন খালের নতুন পানিতে নেমেছিলাম আমি, হীরা, অর্পিতা,ফারিয়া, মেজো ভাবী আর নাতি ফারায। কিন্তু নাতি ফারাযকে সামাল দিতে গিয়ে তিনজনই পেরেশান হয়ে গেছি! তবে হীরা ও অর্পিতা মজা করেছে সবচেয়ে বেশি। রতন, রতনের ছেলে রাফিদ এবং মুক্তার ছেলে জায়েমও পানিতে নেমে কী যে মজা করেছে তারা! সুইমিংপুলের মজাকে মাৎ করে দিয়েছে আমাদের খালের টলটলে কাকচক্ষু রাঙা পানিতে গোসল করার নিখাদ আনন্দ! রামিছা আর তাম্মি ছবি তোলায় ব্যস্ত। ওয়াসিফ, মাফিদ ঘোরঘুরিতে ব্যস্ত। নতুন দুই বউও আনন্দে ছিল বিভোর! আর ছোট্ট দাদুমণি জাইমাও ছিল মহানন্দে!

স্মৃতিচারণায় উন্মুখ হয়ে আমিও গোসল করেছি দু’দিন কিন্তু সেই ছোট বেলায় খালের পানিতে গোসল করে চোখ লাল করে বাড়িফেরা, মায়ের বুকনি খাওয়া সেটা ফিরে পাই নি! মাঝে মাঝে ভেতর থেকে একটা আতপ্ত নিঃশ্বাস নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসছে!
প্রথম দিনই আমার শ্বশুর বাড়ি লক্ষনখোলায় এবং আমার ছোট বোন নাহারের শ্বশুড়ির নানা হাসান আলী মুন্সির বাড়ি চরকাঠালিয়ায়ও গিয়েছিলাম। তার পরের দিন নাহারের শ্বশুর বাড়ি মির্জানগরেও গিয়েছিল অনেকেই।
মূলত যে কয়দিন ছিলাম হৈ হল্লোর ও আড্ডায় ছিলাম আমরা দিলখোলা।

মজার বিষয়, মেজো ভাইয়ের হাঁটুর ওপর ভাঁজ করে লুঙ্গি পরা, খালি গায়ে ঘর্মাক্ত দেহে তীর হাতে কাকের সাদা মল থেকে রান্নার করা খাবার সুরক্ষায় কাক তাড়ানোর দায়িত্ব পালনটা ছিল আবহমান বাংলার সাচ্চা মমত্ববোধের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। আহা রে! ভাইজান সেই সকাল থেকে কী কষ্টটাই না করেছেন!! আসলে কোন কষ্টই যেন তাঁর কাছে কষ্ট মনে হয় নি। বরং ভাইজান চপল আনন্দে সার্বক্ষণিক সহাস্যমুখে এমনি উদ্দীপ্ত ছিলেন যে, মনে হয়েছে জীবনের সামগ্রিক পূর্ণতা যেন তাঁর হাতের মুঠোয়। যা ছিল আমাদের কাছে মনোমুগ্ধকর, আকর্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষক! এক পর্যায়ে খালি গায়ে মুক্তা ছবি ওঠাতে গেলে ভাইজান ইতস্তত করায় মুক্তা বলে, কাকা আই আ্যম প্রাউড অব ইউ। ইউ আর এ প্রাউড ফাদার, প্রাউড গার্ডিয়ান!! পোশাকে নয় কাকা, পরিচয় ভালেবাসায়, ত্যাগে। এতে আমরা প্রাউড ফিল করছি কাকা। আপনি হচ্ছেন আমাদের রোল মডেল, অনুকরণীয় আদর্শ। মেজো ভাই মুক্তার কথা শুনে তাঁর চোখ যুগল যেন আনন্দাশ্রুতে ছমছম করছে।
সবাই ছিলাম কিন্তু তবুও বড় ভাবীর অভাবটা অনুভব করেছি। কারণ, বড় ভাবীর কড়াশাসন-মাখা ধমক এবার পাই নি যার স্বাদ ছিল আমাদের কাছে অমৃতসম। আর আমার মরহুম মা-বাবা এবং বড় ভাইজানের অভাবজনিত বেদনাটুকু কেবলি খচখচ করে বিঁধছে আমার হৃদয়ের মর্মমূলে! আনন্দেের ফাঁকে কষ্টের পীড়নটাও ছিল মর্মস্পর্শী ! রবীন্দ্রনাথের “বলাই”এর মতো কতগুলি ব্যথা আছে এ যেন একান্তই আমার একার! আমি আল্লাহর কাছে মরহুম মা-বাবা এবং ভাই-ভাবী তাঁদের বিদেহী আত্মার বেহেস্ত নসীব কামনা করছি।

অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশনায় রতনের সাথে তাদের দুইজন ড্রাইভার সহযোগিতা করেছেন। আরো সহযোগিতা করেছেন আকলিমা ও শারমীন। আর বাড়িতে আমাদের ঘনিষ্ঠজনরাও আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করেন। আমরা প্রত্যেকেই তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সর্বোপরি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি পরম করুনাময় আল্লাহর কাছে সবকিছু ভালোয়-ভালোয় সুসম্পন্ন হওয়ার জন্য।

আবারো আমাদের পারিবারিক মিলনমেলার প্রত্যাশা রাখছি আমাদের পিত্রালয়ে শীত- ঋতুতে ইনশাআল্লাহ! সেই লক্ষ্যে আপনাদের আশীর্বাদ ও দোয়া প্রার্থনা করছি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *