দেশে ব্যাপক আলোচিত সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে অগ্নিদ্বগ্ধ করে হত্যা মামলায় ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এবং প্রত্যেক আসামিকে এক লক্ষ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বাদী ও বিবাদী পক্ষে যুক্তিতর্ক শেষে মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে।
২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা একজন পিয়নের মাধ্যমে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহানকে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। নুসরাত অধ্যক্ষের কার্যালয়ে গেলে তার ওপর যৌন হয়রানি করে অধ্যক্ষ। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে। এনিয়ে অধ্যক্ষের পক্ষে বিপক্ষে সোনাগাজী উপজেলা সদরে পাল্টাপাল্টি মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। পরে অধ্যক্ষের নির্দেশে তাঁর অনুগতরা নুসরাতের পরিবারকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকে।
গত ৬ এপ্রিল সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী একই মাদ্রানার ছাত্রী নুসরাত জাহান পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় যায়। তখন উন্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন নুসরাতের এক বান্ধবী নাসরিন সুলতানা ফুর্তিকে মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে মারধর করা হচ্ছে বলে ডেকে নিয়ে যায়। মাদ্রাসার ছাদে আগে থেকে বোরকা পরা চারজন অপেক্ষায় ছিলেন। নুসরাত মাদ্রাসার ছাদে ওঠার পর দুর্বৃত্তরা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাতের মায়ের দায়ের করা শ্লীলতাহানির মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয়। এতে নুসরাত রাজী না হওয়ায় দুর্বৃত্তরা পাঁচজন তাঁর হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে হত্যার উদ্দেশ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে হাত ও পায়ের বাধন পুড়ে খুলে গেলে নুসরাত দৌড়ে নিচে নামতে থাকে। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পরে ফেনী ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই দিনই সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে নুসরাত চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়।
এদিকে ৮ এপ্রিল তাঁর ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলাটি ১০ এপ্রিল পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। মামলার প্রথম কর্মকর্তা ছিলেন সোনাগাজী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন, পিবিআইতে স্থানান্তরের পর পরিদর্শক মোহাম্মদ শাহ আলমের ওপর তদন্ত ভার দেওয়া হয়। এ মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ শাহ আলম তদন্ত শেষে ২৯ মে ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ৫ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অভিযোপত্রভূক্ত ১৬ জন আসামির মধ্যে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার বরখাস্তকৃত অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১২জন ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।
অভিযোগপত্র ভুক্ত আসামিরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার বরখান্তকৃত অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলার মাকসুল আলম, মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহি উদ্দিন শাকিল। গ্রেপ্তার ২১ জনের মধ্যে আরিফুল ইসলাম, নুর হোসেন, কেফায়েত উল্যাহ, মো. আলাউদ্দিন ও শহিদুল ইসলামসহ পাঁচ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
১০ জুন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ মামলার ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন, ২০ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন, ২৭ জুন মামলার সাক্ষ্য গ্রহন শুরু হয়। এ মামলায় মোট ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জন আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
ফেনীর সরকারী কৌঁসুলী (পিপি) হাফেজ আহম্মদ জানান, ১৮০ কার্য দিবসের মধ্যে মামলা নিস্পত্তির কথা বলা হলেও ৬১তম কার্যদিবসে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ মামলা প্রমাণ করতে পেরেছে। সারা দেশের মানুষ এ চাঞ্চল্যকর মামলার রায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করেন।