তুয়ারেগ পুরুষ: যাদের মুখ ঢাকাই থাকে

আন্তর্জাতিক

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমির বুকে আপনি হাঁটছেন। মানচিত্রে দেখাচ্ছে উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা। চারদিকে আদিমকালের দৃশ্যপট। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উঁচু-নিচু বালুর ঢেউ। মাঝে মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বিলুপ্ত প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো চকচকে পাথরের দেয়াল। হঠাৎ সন্ধ্যার ঝোঁকে আপনার সামনে এসে দাঁড়াল কয়েকজন লোক। তারা সামনে এসে আপনার কুশল জানতে না চাইলে অবাক হবেন না। হঠাৎ করেই তারা যেন হাওয়ার মধ্যে থেকে এসে হাজির। আচমকাই তাদের আপনি দেখতে পাবেন। সারা গায়ে কাপড় জড়ানো। তরবারি কোমরে আর বাঁ হাতে তীক্ষ্ণ বর্শা। ডান হাতে রুপার বাঁটওয়ালা বাঁকা ছুরি। তাদের চেনার উপায় নেই। কারণ, এই পুরো দৃশ্যের মধ্যে আপনি দেখতে পাচ্ছেন কেবল এক জোড়া শান্ত সতর্ক চোখ। পুরো মুখ দেখা যাচ্ছে না। চাইলেও আপনি তা দেখতে পাবেন না।

যাদের দেখছেন তাদের সবার মুখ ঢাকা। তুয়ারেগ পুরুষ কখনো পুরো মুখ দেখায় না। তুয়ারেগ নারী নয়, পুরুষেরা পুরো মুখ ঢেকে রাখে। শুধু চোখ আর কখনো নাকের ডগা কাপড়ের বাইরে থাকে। কৈশোর পার হয়ে, কোন গোত্রে বা ২৫ বছর বয়সের পর থেকে তুয়ারেগ পুরুষ নিজের মুখ ঢেকে রাখে। রীতিমতো অনুষ্ঠান করে কৈশোর পার হওয়া তরুণকে তার কাকা-জেঠারা পূর্ণ বয়স্ক ঘোষণা দিয়ে মাথা আর মুখ ঢাকার চাদর পরিয়ে দেন।

এমনকি পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের সামনেও মুখের ওপর থেকে কাপড় সরানোর নিয়ম নেই। সেই কাপড় নীল রঙে ছাপানো। প্রাচীন আর মধ্যযুগের পরিব্রাজকেরা তাদের বলতেন নীল মানুষ। সাদা মেঘের মতো উড়ে চড়ে তারা ঘুরে বেড়ায় মরুভূমির বুকে। নিজেদের তারা যোদ্ধা ভাবতেই ভালোবাসে। তাদের ইতিহাসও সেই কথা বলে।

মুখ তারা ঢেকে রাখে শত্রুদের কাছে নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে। একাদশ শতাব্দীতে স্বর্ণ, লবণ, হাতির দাঁত আর দাস ব্যবসার পথ বদলানোর পর টিম্বকটু শহর জমজমাট হয়ে উঠল। সেই শহর ছিল তুয়ারেগদের চৌহদ্দির ভেতর। এরপর ৪০০ বছর তারা ব্যবসা করল, যুদ্ধ করে এলাকা দখল করল, বণিক দলের কাছ থেকে কর আদায়, তারা রাজি না হলে ডাকাতি—এভাবে জমজমাট কাটল। এ রকম জীবনযাত্রা থেকেই তুয়ারেগ পুরুষদের মধ্যে নিজের মুখ ঢেকে রাখার প্রথা চালু হয় বলে মনে করা হয়। এমনিতেও মরুভূমিতে জীবন কাটানো জনগোষ্ঠী চলাফেরার সময় বালু থেকে নিজেদের রক্ষা করতে মুখ ঢেকে রাখে। কিন্তু তুয়ারেগ পুরুষদের মধ্যে মুখ ঢেকে রাখা এক কঠিন প্রথা।

তুয়ারেগ মানুষদের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথাগত ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েও তারা নিজেদের আদি কিছু প্রথা জীবনের সঙ্গে জুড়ে রেখেছে। শিশুর জন্মের পর তার মাথার দুই পাশে মাটিতে দুটো ছুরি গেঁথে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে তার সুরক্ষা আর আত্মরক্ষার প্রতীক হিসেবে। তুয়ারেগ ভাষা ওপর নিচ, বাঁ থেকে ডান বা ডান থেকে বাঁ—সবদিক থেকে লেখা যায়। লাইন, বিন্দু এবং বৃত্ত দিয়ে তৈরি এই ভাষার বর্ণ সেই ব্যাবিলন বা ফিনিশীয়দের প্রাচীন লিপির সাক্ষাৎ আত্মীয় বলে মনে হয়।

মুখ ঢাকা তুয়ারেগ পুরুষ, ১৯০৮। ছবি: উইকি মিডিয়া কমনসমুখ ঢাকা তুয়ারেগ পুরুষ, ১৯০৮। ছবি: উইকি মিডিয়া কমনস

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তুয়ারেগ নারীরা প্রতিবেশী যেকোনো জাতির নারীদের চেয়ে স্বাধীন। সম্পত্তির উত্তরাধিকারে তাদের কোনো বাধা নেই। বিয়ে করার ক্ষেত্রে নারীদের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। উদার মেজাজ, স্বাধীনচেতা, কিন্তু খুব মেজাজি হিসেবে তুয়ারেগ নারীরা বেশ পরিচিত। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নারীরা একা মরুভূমিতে চলে যেতে পছন্দ করেন। সমাজে তাদের কদর খুব। অনুষ্ঠানে নারীরা বাদ্যযন্ত্র বাজান। স্বামীরা পশু চরান। ঘর-গৃহস্থালিতে কী হবে, সেই সিদ্ধান্ত নারীদের হাতেই থাকে।

গভীরভাবে স্বাধীনচেতা এই মানুষগুলো তাদের অঞ্চলে সহজে কাউকে অনুপ্রবেশ করতে দেয়নি। সাহসী যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত তুয়ারেগরা আফ্রিকার অন্য জাতি, আরব বা ফরাসি, কাউকেই ছেড়ে কথা বলেনি। আজও তাদের কারও অধীন বলা যাবে না।

ফরাসিরা টিম্বুকটুতে তুয়ারেগদের হারিয়ে দিয়ে মালি দখল করল। আফ্রিকার সেই অঞ্চল প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৃত্রিম রাষ্ট্রে ভাগ হলো। উপনিবেশকাল শেষ হওয়ার পর তুয়ারেগরা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। অস্থির আফ্রিকার বিভিন্ন শাসক, সামরিক জান্তা—এরা কেউ তাদের সহজে মেনে নেয়নি।

পশ্চিম আফ্রিকার মানুষদের মধ্যে ফরাসিরা তুয়ারেগদের সব শেষে দমন করতে পেরেছে। তাদের জমি নাইজার, মালি, আলজেরিয়া আর লিবিয়া নামের রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। তাদের অবস্থা হলো কুর্দিদের মতো। রাষ্ট্রগুলো এই ক্ষুদ্র সংখ্যার জনগোষ্ঠীকে কার্যত উপেক্ষা করে। হাজার বছর তুয়ারেগ মানুষেরা গবাদিপশু নিয়ে বিচরণ করেছে। মরুভূমিতে এন্টিলোপ শিকার করেছে। সেই ভূমি এখন আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে ভাগ হয়েছে। ইচ্ছে হলেই সেখানে যাওয়া যায় না। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে বৃষ্টির পরিমাণ কমছে। তুয়ারেগদের জীবন হচ্ছে উট আর ছাগল। খাদ্য, পানীয়, আশ্রয় আর নগদ অর্থ—সবকিছুর একমাত্র উৎস এই পশু। পশু নেই, তুয়ারেগ নেই। ১৯৭০–এর দশকে কয়েক বছর ধরে চলা খরায় প্রায় ১০ লাখ তুয়ারেগের মধ্যে সোয়া লাখ নিহত হলো। এখন তাদের সংখ্যা সাকল্যে ২৫ লাখ।

তাদের চারণভূমিতে এখন ইউরেনিয়ামের খনি। মরুভূমিও চলে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে। সেখানে নতুন খনিজের অনুসন্ধান চলছে। সরকারের কাছে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ না পেয়ে নাইজারের তুয়ারেগরা বিদ্রোহ করল। এর মধ্যে মাদক ব্যবসায়ী আর আল–কায়েদার কিছু অংশ তুয়ারেগ–অধ্যুষিত অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়ল। নাইজার সরকার দোষ দিল তুয়ারেগদের। তুয়ারেগরা নিজের ওপর কোনো অন্যায় সহজে কোনো দিন মেনে নেয়নি। তাদের প্রবাদ আছে, ‘যে হাত কেটে আলাদা করা যায় না, তাতে চুমু খাওয়াই ভালো’। এই প্রবাদে বোধ হয় সময়ের সঙ্গে বদল এসেছে। কয়েক দফায় নাইজার সরকারের সঙ্গে তুয়ারেগদের সশস্ত্র সংঘাত হয়েছে। ফরাসিদের মধ্যস্থতায় সালিস হয়েছে। পরিস্থিতি এখনো শান্ত হয়নি।

পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। লবণের ব্যবসা আর চারণভূমি খুঁজে সেখানে পশু চরানোর দিন শেষ হয়ে আসছে। খনিজ ব্যবসার হাতে পড়ে শিকার লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মরুভূমির জীবন শেষ হয়ে আসছে। এখন হয়তো মুখের আবরণ সরাতেই হবে।

বিভিন্ন ওয়েবসাইট অবলম্বনে লেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *