কুলিয়ারচরে ইউএনও’র হাতে “জেলে ত্রিশ বছর” বই তুলে দিলো চেতনা সংস্থা।

বাংলাদেশ

শাহীন সুলতানা, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি :কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে মহারাজ ত্রৈলোক্য নাথ চক্রবর্তী’র লিখা ব্রিটিশ : পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস “জেলে ত্রিশ বছর” বই উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাউসার আজিজের হাতে তুলে দিলেন চেতনা পরিবেশ মানব উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোঃ মুছা।

বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারী) সকাল ১১টার দিকে উপজেলা নিবার্হী অফিসার কার্যালয়ে নির্বাহী অফিসার কাউসার আজিজের হাতে “জেলে ত্রিশ বছর” বইটি আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দেওয়ার সময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ নূরে আলম, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ আলতাফ হোসেন ও মহারাজ ত্রৈলোক্য নাথ স্মৃতি পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক অনিল চন্দ্র সাহা।

জানা যায়, জেলে ত্রিশ বছর বইটি প্রথম মুদ্রণ হয় ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানে। পরে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানী সরকার বইটি নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। বইটির একমাত্র পরিবেশক ছিলেন, শিশু সাহিত্যিক ও প্রকাশক নওরোজ এর মোহাম্মাদ নাসির আলী। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম সংস্করণ হয় ঢাকা বইমেলায়-২০০৪ সালে। দ্বিতীয় মুদ্রণ হয় ২১শে বইমেলায়-২০১০ সালে। তৃতীয় মুদ্রণ হয় জানুয়ারি-২০১৫ সালে। বইটি ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন প্রকাশনার পক্ষে একমাত্র পরিবেশক নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, বাংলা বাজার ঢাকা-১১০০।

বইটি থেকে লেখকের জীবন সর্ম্পকে যা জানা যায়, পৃথিবীতে সম্ভবত আমিই রাজনৈতিক আন্দোলন করার কারণে সর্বাধিক সময় জেলখানায় অতিবাহিত করিয়াছি। মাঝখানে দু-এক মাস বিরতি ছাড়া আমি ১৯০৮ সাল থেকে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত ৩০ বছর কারাগারে কাটাইয়াছি, ৪/৫ বছর অজ্ঞাতবাসে কাটাইয়াছি। জেলখানার পেনাল কোডে যেসব শান্তির কথা লেখা আছে এবং যেসব শান্তির কথা লেখা নাই তাহার প্রায় সব সাজাই ভোগ করিয়াছি।’ ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী এমন কথাই লিখে ছিলেন তার আত্মজীবনীর ভূমিকায়। সব মিলিয়ে ৩৪ বছর অতিবাহিত করেন জেলে। তিনি শুধু বিপ্লবীই ছিলেন না; ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক, সমাজ সংস্কারক ও লেখক। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে প্রগতিশীল দলের প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান এসেম্বলিতে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছিলেন তিনি।
কিন্তু মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে (মহারাজ চক্রবর্তী) ভুলে গেছে কুলিয়ারচরবাসীর, দখল হয়ে গেছে তার পৈত্রিক সম্পদ। ১৮৮৯ সালের ৫ মে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ত্রৈলোক্যনাথ। তাঁর পিতা দুর্গাচরণ চক্রবর্তী ছিলেন স্থানীয় জমিদার ও স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক। তবে স্মৃতি চিহ্নস্বরূপ উপজেলা প্রাঙ্গণে একটি পাঠাগার ছাড়া গ্রামের বাড়িতে কোন কিছু অবশিষ্ট নেই তার।

১৯৫৩ সালে প্রথম মুদ্রণ হয় তার আত্মজীবনী ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস’ বইটি। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে বইটি নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। ১৯৮১ সালে তা পুনঃপ্রকাশ হয়। তাতে জানা যায়, ১৯০৬ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময় তাকে সাটিরপাড়া হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। তবে বিপ্লবী কাজের জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষার ঠিক আগে গ্রেফতার হলে তার প্রথাগত শিক্ষার ইতি হয়।

ত্রৈলোক্যনাথের সংগ্রামী জীবন বহুঘটনায় বিচিত্র। ১৯১৪ সালে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে দীর্ঘ ১০ বছরের কুখ্যাত আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দি থাকতে হয়। ১৯২৮ সালে মুক্তির হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মিতে যোগ দেন। ১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেসের যোগ দেন তিনি। ১৯৩৮ সালে মুক্তির পর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করে রামগড় কংগ্রেসে যোগ দেন। ব্রিটিশ ভারতে সর্বশেষ ১৯৪২ সালে ‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় ৪ বছর জেলে কাটাতে হয় তাকে।

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ও দেশ ভাগের পর তিনি মাতৃভূমি বাংলাদেশকেই বেছে নেন বসবাসের জন্য। এই সময় তিনি বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুরা যেন দেশত্যাগ না করে চলে যায়, সে বিষয়ে জেলায় জেলায় গিয়ে প্রচারণা চালান। এই কার্যক্রম পূর্ব পাকিস্তানের সরকার মানতে পরেনি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে তাকে দুই বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখে পাকিস্তান সরকার।

জীবনের শেষ সময়ে চলে আসেন গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে। সে সময় হাঁপানি মারাত্মক রকম বেড়ে যায় ও হৃদরোগ ধরা পড়ে। অনেক চেষ্টা-তদবিরে ১৯৭০ সালে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য পাকিস্তাান সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পান। এই সময় সংবর্ধনার জন্য তাকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই বছরের ৯ আগস্ট সেখানেই তিনি মারা যান।

ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর তার আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘আমার স্বপ্ন সফল হয় নাই, আমি সফলকাম বিপ্লবী নই। আমার ব্যর্থতার কারণ, আমার দুর্বলতা নয়। আমি কখনো ভীরু ছিলাম নাÑ আমার জীবনে কখনো দুর্বলতা দেখাই নাই। আমি আমার চরিত্র নির্মল ও পবিত্র রাখতে সক্ষম হইয়াছি। অর্থলোভ আমার ছিল না। এই সময় হাজার টাকা আমার হাতে আসিয়াছে কিন্তু সে টাকা নিজের ভোগ-বিলাসিতার জন্য ব্যয় করি নাই। …. আমার ব্যর্থতার কারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আমার ব্যর্থতার কারণ একজন দক্ষ ও সফলকাম বিপ্লবীর যতটা ধীশক্তি ও জন-গণ-মন অধিনায়কতার যে ব্যক্তিত্ব থাকা আবশ্যক তাহার অভাব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *