কুলিয়ারচরের কৃতী সন্তান শাহাদত হোসেন কবিরের ‘মাটির মায়া’ এখন সারাদেশে।

বাংলাদেশ

শাহীন সুলতানা, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি :

চার বছর আগের কথা। রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসিল্যান্ড তাঁর বসার জন্য অফিসের নিচে একটি টিনশেড বানিয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘মাটির মায়া’।

সকালে এসে সেখানেই বসতেন তিনি। আগে গ্রামের সহজ সরল মানুষ সেবা নেওয়ার জন্য ওই ভূমি অফিসে ঢুকতে গেলেই দালালদের খপ্পরে পড়তে হতো। সেখানে ওই এসিল্যান্ড দালাল তাড়িয়ে দ্রুত সেবা নিশ্চিত করার জন্য দেড় বছর খেটেখুটে অফিসের সমস্ত নথি ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এখন সেখানে চাহিবামাত্রই সেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

পবা ভূমি অফিসের এই পরিবর্তনের বিষয়টি লোকজনের কাছে খোঁজ নিয়ে মনে হলো, দেশে মানুষে মানুষে বিরোধের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে ভূমি বিরোধ। ভূমি অফিসে কাজের দীর্ঘ সময় লাগার কারণেও এই বিরোধের নিষ্পত্তি সহজে হয় না। পবা ভূমি অফিস সেই জায়গায় হাত দিয়েছিলেন। এক বছর ঘুরে যে কাজ হয়নি, এক দিনে বা এক সপ্তাহেই তা হয়ে যেতো। তার জন্য বাড়তি কোন টাকা দিতে হতোনা।

জানা যায়, রাজশাহীর পবা উপজেলা ভূমি অফিসের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড ছিলেন শাহাদত হোসেন কবির। তিনি ১৯৭৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া আব্দুল্লাপুর ইউনিয়নের বড়চারা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মোজাম্মেল হক এবং মাতার নাম শামসুন্নাহার।

শাহাদত হোসেন কবির স্থানীয় বড়চারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী কিছুদিন স্থানীয় লক্ষ্মীপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেন। এরপর যথাক্রমে পার্শবর্তী ভাগলপুর আফতাব উদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ১৯৯৪ সালে এইচএসসি, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে বিএ (অনার্স), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ) ২০০২ সালে এমএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ) ২০০৩ সালে ২৭তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারের চাকুরিতে যোগদান করেন।

চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর জয়পুরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করেন। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেন।

শাহাদত হোসেন কবির অফিসের নিচে টিনশেডে বসে ডাক্তারদের মতো একজনকে ডাকতেন আর তাঁর কথা শুনতেন। কাউকে তাৎক্ষণিক সমাধান দিয়ে দিতেন। আবার জটিল বিষয় হলে তাঁর হাতে একটা টোকেন ধরিয়ে দেখা করার তারিখ লিখে দিতেন। তাৎক্ষণিক সেই সেবা পেয়ে কোনো কোনো ভুক্তভোগী চোঁখের জল ফেলে কেঁদে ফেলতেন । আবার দু’হাত তুলে ওই এসিল্যান্ডের জন্য পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নিকট দোয়া করতেন।

এই ভূমি অফিসের সেবার দৃষ্টান্ত নিয়ে এসি ল্যান্ডের ‘মাটির মায়া’ শিরোনামে ২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকায় একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর যেন প্রশাসনের চোঁখ খুলে যায়। তখনই সরকার ‘মাটির মায়া’কে মডেল হিসেবে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সারা দেশের সব এসিল্যান্ড, ইউএনও, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কপিসহ চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, রাজশাহী জেলার পবা উপজেলা ভূমি অফিসের আদলে সব ভূমি অফিসে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্যোগ বাস্তবায়নের সময়কালও বেঁধে দেওয়া হয়।

‘মাটির মায়া’র উদ্ভাবক শাহাদত হোসেন কবির বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত।

জানা যায়, সারা দেশে শত শত সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে এখন ‘মাটির মায়া’র আদলে সেবা কার্যক্রম চলছে। পরবর্তী সময়ে এই সেবা আরও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। শাহাদত হোসেনের পরবর্তী এসিল্যান্ডরা মাটির মায়ার সেবাকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন। জানা গেছে, সারাদেশে নতুন প্রজন্মের এসিল্যান্ডরা মাটির মায়ায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভূমি সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলার এসিল্যান্ড অফিসেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সর্বত্র মাটির মায়ার আদলে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। মানুষের বসার জায়গা, হেল্পডেস্ক, নাগরিক সনদ, উন্মুক্ত গণশুনানি, অফিসের ওয়েবসাইট ইত্যাদি সেবামূলক কাজে এগিয়ে গেছে বেশকিছু উপজেলা ভূমি অফিস।
শাহাদত হোসেন কবির পরবর্তীতে টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার এবং পরে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে যোগদান করে কাজ করেছেন। ওই দুটি উপজেলায় তিনি মাটি ও মানুষের সাথে মিশে কাজ করায় এলাকার মানুষ তাঁকে মাটির মানুষ উপাদী দিয়েছিলেন। ওই দুটি উপজেলায় ভূমি খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি মাদক, বাল্যবিবাহ, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতি দূরীকরণের পাশাপাশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ উন্নয়ন, খেলাধুলা, যুব উন্নয়ন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন।

বিশেষ করে দেলদুয়ার উপজেলায় সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতায় এক দিনে আড়াই লক্ষ গাছ লাগিয়ে তিনি আরো এক দফা সারাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।

তাঁর বিদায় দিনে উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চোঁখের জলে ভিজেছিল প্রত্যেকের সারা শরীর। কেঁদেছিল শিক্ষক শিক্ষিকা, সরকারী চাকুরীজীবী সহ সাধারণ মানুষ। কেননা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হয়েও তিনি গ্রাম গঞ্জে গিয়ে সকলের খোঁজ খবর নিতেন। যে কোন সমস্যায় পরে মানুষ তাঁর নিকট দেখা করার সুযোগ পেতেন খুব সহজেই। কারণ তাঁর অফিসের দরজা ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত।

পবা, দেলদুয়ার ও মধুখালী উপজেলাবাসী এখনো তাদের প্রিয় কর্মকর্তা শাহাদত হোসেন কবিরকে স্মরন করে চোঁখের জল ফেলে।

শাহাদত হোসেন কবিরের স্কুল জীবনের বন্ধু ও সহপাঠী মোঃ আব্দুল মালেক (কবির) বলেন, ছাত্র জীবনে শাহাদত হোসেন কবির নম্র, ভদ্র, সৎ ও নিষ্ঠাবান হওয়ায় সকলের প্রিয় ছিলেন। তার কাজকর্মে শিক্ষকমন্ডলী সহ সকলের প্রশংশা পেতেন।

যোগাযোগ করা হলে শাহাদত হোসেন কবির জানান, সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করাই তাঁর লক্ষ্য। যে পদেই থাকেন না কেন সেখান থেকেই তিনি জনগনের জন্য কাজ করবেন। তিনি নিজের সবকিছু দিয়ে কাজ করে যেতে চান। সুযোগ পেলে নিজের এলাকায়ও তিনি কাজ করে যাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.