উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদদদাতা ১৫০ নেতার কাছে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। আজ রবিবার ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে কেন দল থেকে বহিষ্কার করা হবে না মর্মে শোকজ নোটিশ পাঠানো শুরু হবে। এই তালিকায় মদদদাতা হিসেবে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা, ছয় জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৬২ জন এমপির নাম আছে।
এছাড়া মদদদাতা হিসেবে তৃণমূলের নেতা এবং উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিদ্রোহী) হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হওয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাছেও ডাকযোগে শোকজ নোটিশ যাবে। এর মাধ্যমে দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু হচ্ছে।
আগামী অক্টোবরে দলের জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখেই এই শুদ্ধি অভিযান। জানা গেছে, শোকজ নোটিশের জবাব পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড তা যাচাই-বাছাই করে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী ও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের চূড়ান্তভাবে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করে তা দলের পরবর্তী কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে উপস্থাপন করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় ঐ বৈঠকে আলোচনা শেষে চূড়ান্ত বহিষ্কার হওয়া বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদদদাতাদের তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে।
শনিবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী ছিল, তাদের শোকজ করার সিদ্ধান্ত আগে থেকেই ছিল। আজকে সেটা বাস্তবায়নের প্রসেস কীভাবে দ্রুত করা যায়, সেটা আলোচনা করেছি। রবিবার থেকে ১৫০টির মতো শোকজ নোটিশ ইস্যু হবে। শোকজের জবাবের জন্য তিন সপ্তাহ সময় দেওয়া হবে।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, এই তালিকায় কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও থাকবেন। শৃঙ্খলার ব্যাপারে কারো প্রতি শৈথিল্য দেখাবে না দল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বিদ্রোহীদের মদদদাতা মন্ত্রী-এমপিরাও শোকজ পাবেন। তবে তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘মদদদাতাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতাও থাকতে পারেন। দলের যারা জ্যেষ্ঠ নেতা, কেন্দ্রীয় নেতা বা মন্ত্রী-এমপি মদদদাতার ভূমিকায় ছিলেন, তাদের শোকজ করা হবে।’
জানা গেছে, ৬২ জন মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মদদদাতা হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর (বীর প্রতীক), বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, পাবনার সংসদ সদস্য অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস, সংসদ সদস্য শহীদুল ইসলাম বকুল, কুমিল্লা-২ আসনের এমপি সেলিমা আহমাদ মেরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের এবাদুল করিম বুলবুল, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারী, ময়মনসিংহ-৯ আসনের আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন, মুন্সীগঞ্জ সদরের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণচন্দ্র চন্দ, চুয়াডাঙ্গার সংসদ সদস্য আলী আজগর টগর, সোলায়মান হক জোয়ার্দার, গাজীপুরের ইকবাল হোসেন সবুজ, বরগুনার ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, ঠাকুরগাঁওয়ের দবিরুল ইসলাম, সুনামগঞ্জের মোয়াজ্জেম হোসেন, সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের ড. আজিজ, সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান প্রমুখ।
তাদের কাছে শোকজ নোটিশ পাঠানো হতে পারে। তবে গতকাল রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে তালিকা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হয়েছে। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল। জানা গেছে, অধিকাংশ বিদ্রোহীর পেছনে ছিলেন আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলী ও সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মদদদাতা হিসেবে শোকজ নোটিশ পাঠানো হতে পারে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ইত্তেফাককে জানান, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তাদের সবাইকে শোকজ নোটিশ পাঠানো হবে।
সম্প্রতি পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ৪৭৩টি উপজেলা নির্বাচনের ১৪৯টিতে চেয়ারম্যান পদে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১৪০ জনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাকে দলের বিদ্রোহী হিসেবে ধরে নেয় আওয়ামী লীগ।
শুদ্ধি অভিযান প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ১৫০ জনের বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ পাঠানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হলেও তা বেড়ে দুই শতাধিক হতে পারে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিদ্রোহী) হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হওয়া ১৪০ জন উপজেলা চেয়ারম্যানের নামও রয়েছে। দলে শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি এ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে একগুচ্ছ সাংগঠনিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।
বিদ্রোহীদের আশকারা ও মদদ দিয়েছেন ১৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা
তৃণমূল নেতারা সব সময়ই কেন্দ্রীয় নেতাদের একধরনের চাপে থাকেন। তবে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বিদ্রোহী প্রার্থী ইস্যুতে এখন উলটো চাপ ও ভয়ে আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। আতঙ্কে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলটির সংসদ সদস্যরাও। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা বলেন, শোকজের এ সিদ্ধান্তে দলের ভেতরে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা অস্বস্তিতে পড়েছেন। কারণ বিদ্রোহীদের আশকারা ও মদদ দিয়েছেন ১৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা। দলের শতাধিক সংসদ সদস্য সরাসরি বিদ্রোহীদের পক্ষে মাঠে কাজ করেন। কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীও বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিলেন।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের শোকজের জবাবের মধ্য থেকেই তাদের মদদদাতাদের চিহ্নিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। শোকজের জবাবের মধ্যেই জানতে চাওয়া হবে কোন কোন কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী-এমপি কিংবা জেলার নেতারা তাদের উত্সাহিত করেছেন বিদ্রোহী প্রার্থী হতে। কারা কারা তাদের মদদ কিংবা সমর্থন দিয়েছেন।