♣ভালো থাকার সহজ উপায় – ৩ (পর্ব-১)♣
(ছবির কৃতিত্বঃ খবির সবুজ)
—পিয়ারা বেগম
২৩ জানুয়ারী, ২০১৫ ইং। ভোরে লেখার টেবিলে বসে ভাবছি একটা আর্টিকেল লিখব। তখনি মাইকিংয়ে আমার এক প্রিয়ছাত্রের মৃত্যুর খবর প্রচার হচ্ছে। শামীম সুমন খান হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে। ৩০ – ৩২ বছর হবে হয় তো। তরুণ, টগবগে যুবক। আচমকা মৃত্যু সংবাদ শুনে ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে ওঠল। মিতভাষী, শান্ত সুমনটা হঠাৎ এমনি করে হারিয়ে গেল চিরতরে ! ওর মায়াবী আলাভোলা চেহেরাটা যেন বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠল ! ওর এমন করে চলে যাওয়াটা যেন কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না ।
থমকে গেল আমার লেখার স্পৃহা । আমার সমস্ত অস্থিত্ব জুড়ে চেতন-অবচেতন মনে তখন কেবলই সুমনের মৃত্যুচিন্তা ! শোকাভিভূতিতে কাতরপ্রায় । বিষণ্ণ, বেদনাহত মনের অস্থিরতার মধ্যে ভাবছি এ ক্যামন চলে যাওয়া ?
এই অলোকসামান্য পৃথিবীতে অলোকসুন্দর জীবনের রস-মাধুর্যে ভরপুর এবং উচ্ছ্বল, উপচেপরা আনন্দ-মদির-মত্ততায় দোল-দোলনায় দোল খাওয়ার কথা ছিল যার, সদ্যফোটা তরতাজা মধুগন্ধময়-ঘ্রাণসমৃদ্ধ পাপড়িমেলা গোলাপের মতো সৌন্দর্যের গন্ধ বিলানোর কথা ছিল যার, দীপ্র উজ্জ্বল প্রদীপের মতো শতশত বিচ্ছূরিত আলোকরশ্মি ঝলক ঝলকানিতে আলোয়-আলোয় তার অনন্ত সম্ভাবনাময় জীবনকে কর্মোদ্যমে প্রজ্জ্বলিত করার কথা ছিল যার তাকে কী না চলে যেতে হলো নিয়তির অলিখিত নির্দেশে ! এমনই শোকসন্তপ্ত জবুথবু মুহূর্তে প্রথিতযশা খ্যাতিমান লেখক হুমায়ুন আজাদের লেখার কথা মনে পড়ে গেল । তিনি বলেছেন, ” পৃথিবীটা এমনি । সব মানুষের এক অসমাপ্ত কাহিনীব । কোন মানুষই তার জীবনের সব ঘটনা,সব কাজ, সব দায়িত্ব শেষ করে যেতে পারে না, অনেকখানি বাকী থেকে যায়। ঠিক খেলার মাঠের দর্শকের মতো । দর্শকরা যেমন অনেকেই খেলা শেষ হওয়ার আগেই খেলার মাঠ ছেড়ে চলে যায় । মানুষকেও জীবনের অনেকটা বাকী থাকতেই ডাক আসলে চলে যেতে হয় । খেলার মাঠের দর্শকরা যায় নিজের প্রয়োজনে আর মানুষ যায় প্রকৃতির অমোঘ টানে ।
এ মুহূর্তে রহমতউল্লাহর সেই বাণীটি মৃত্যু সম্পর্কে আমরা আরো একটা স্বচ্ছ ধারনা পাব । তা হচ্ছে, ” জীবনের চূড়ান্ত অবলুপ্তিই হচ্ছে মৃত্যু ! মৃত্যু মানে জীবন থেকে ফোরসিবলি রিটায়ারমেন্ট , মৃত্যু মানে অনন্তকালের অনন্তশুন্যতায় মিলিয়ে যাওয়া ! ” কী কঠিন নির্মমতা !! ভেতরটা যেন এক অজানা আশংকায় অতিকায়ভাবে ধুকধুক করে ওঠছে । আর কানে বাজছে বিজয় সরকারে লেখা ও সুরারোপিত সেই গান, “এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনি রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে রে মন, চলে যেতে হবে !”
মৃত্যুব ! মৃত্যু এক অপ্রতিরোধ্য কঠিন বাস্তবতা !! মৃত্যু মানে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন-কল্পনার রোমান্টিক পৃথিবী । মৃত্যু মানে রেখে যাওয়া কিছু বেদনাবোধ, মৃত্যু মানে কিছু আক্ষেপ, কিছু অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি । মৃত্যু মানে অভিজ্ঞতাহীন অন্ধকার এক অনিঃশেষ নতুন জগতের সূচনা ।
এই একটা বিষয়ে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ একমত যে , জীবনের সবচেয়ে নিশ্চিত ঘটনা হচ্ছে মৃত্যু ! কিন্তু সময়টা অনিশ্চিত !! জন্মের পর থেকেই মৃত্যু উদ্যত বল্লম আমাদের পাশাপাশি হাঁটছে আমাদের ‘জান’ কবজ করার জন্য । স্রষ্টার নির্দেশ জারি হওয়ার সাথে সাথে মৃত্যু বল্লম গেঁথে ফেলবে আমাদেরকে। কারণ! জন্মলগ্ন থেকেই আমরা সবাই মৃত্যুতালিকাভুক্ত হয়ে আছি । এটাই চিরায়ত, শাশ্বত, সত্য।
এ পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যিনি মৃত্যু-ভাবনায় কাতর হোন না । জল্লাদ-খুনি এমন কী ইস্পাত-কঠিন হৃদয় কিংবা লৌহ মানবও মৃত্যুভাবনায় ব্যথিত হোন , বিমর্ষ ও ভীতস্ত্রস্ত থাকেন । তাই তো বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের তরুণদের বই পড়া আন্দোলনের মূল স্থপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ” মৃত্যুচিন্তার মতো বিরক্তিকর ইভটিজার আর নেই । সে শিশু থেকে শুরু করে কিশোর যুবক, বৃদ্ধ-পৌঢ় সবাইকে টিজ করে । এমন কী মৃত্যুপথযাত্রীকেও ।” মূলত মৃত্যুভয়-ভাবনা থেকে কারোরই নিষ্কৃতি নেই । এমন কী কবি মাইকেল মধুসদনদত্তও জীবন-মৃত্যু নিয়ে তার আক্ষেপের অন্ত ছিলনা। তাই তো তিনি লিখেছেন
জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থায়ী কবে নীর, হায় রে জীবন নদে ।
সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টি ও বিমুগ্ধকর কারিগরি পরিবেশনা এবং এমন অলোকনন্দিত অসম্ভব সুন্দর থৈ থৈ আনন্দের মহাসমুদ্রে আকন্ঠ ডুবে থাকা মনোমুগ্ধকর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার তীব্র আকুলতাবোধই মৃত্যু-ভাবনায় হয় তো আমাদেরকে এমনি ভয়কাতুরে করে রাখে ।
উল্লেখ যে, এই আর্টিকেলটি লেখা হয়েছিল আমার ছাত্র সুমনের অকাল প্রয়াণে তার মতো স্বাভাবিক রোগ-ব্যাধি-জরায় যারা মৃত্যু বরণ করেন তাদের স্বজনদের সহমর্মিতা ও সান্তনা প্রদান করা ! কিন্তু লেখাটা ছাপানো হয়নি কোথাও, এটা এমনিতেই পড়েছিল খাতাবদ্ধ হয়ে ।
কিন্তু সম্প্রতি ফেসবুকের সুবাদে প্রতিনিয়ত মৃত্যু সংবাদসম্বলিত খবরে আমি বেদনাভারে পর্যুদস্ত । আমাদের দেশের সেই রানা প্লাজা ট্রাজেডি থেকে শুরু করে পুরানো ঢাকার নিমতলি ট্রাজেডি, হলি আর্টিজান হামলা, গুলশানের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড, নিউজিল্যান্ড মসজিদে হামলা, সর্বশেষ শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলা দেশ-বিদেশে মানুষকে আতংকিত করে তুলছে ।
তাছাড়া আলোড়ন সৃষ্টকারী নুসরাতের পুড়িয়ে মারার ঘটনাসহ অসংখ্য শিশু ও নারী নির্যাতন ও ধর্ষনজনিত হত্যার রক্তাক্ত ক্ষত শুকাতে না শুকাতে আবারো মানুষ নামের পশুদের লালাঝরা লোলুপতার শিকারে ধর্ষিত হয়ে নির্মম ভাবে নিহত হয়েছেন স্বর্ণলতা নামের বাসে ইবনে সিনার নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়া । প্রতিনিয়ত এমনি পাশবিকতা ও সহিংসতা আমাদের মানবতাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে । যেন কিছুতেই থামছে না বা থামানো যাচ্ছে না মানবতাবিরোধী এসব কর্মকান্ড। তাই তো দেখতে হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল, শুনতে হচ্ছে নির্মমতার মৃত্যুর সব খবর !
তাছাড়া সম্প্রতি যেন মৃত্যুর লাইন পড়েছে গানের শিল্পীদের । একে একে চলে যাচ্ছেন সুরেলা গানের পাখিরা । চলচ্চিত্র অঙ্গনেও লেগেছে মৃত্যুর পরোয়ানা জারীর বিরামহীন নোটিশ ! একে একে জীবন থেকে ঝরে পড়ছে খ্যাতিমান অভিনেতারা !
যাঁরা স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করছেন তাদের মৃত্যুটাকেই মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে উপরুন্তু নারী ও শিশু ধর্ষনজনিত হত্যা, সহিংসতা এবং দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কষ্টের তীব্রতা এত বেশি যে ,আমি সেই আর্টিকেলটিকে ঘষামাজা করে পোস্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি । মৃত্যু ব্যক্তির স্বজনদের উদ্দেশ্যে কিছু সান্তনাসূচক কথা, তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানানোই আমার একান্ত চাওয়া । আর আমার এই লেখাটা তাঁদেরকে উৎসর্গ করছি যাঁরা তাদের স্বজনদের মৃত্যুবেদনাবিদ্ধ হয়েও বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বেঁচে আছেন প্রিয়জনের দুঃসহ স্মৃতির কষ্টকে বুকে লালন করে ।
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে, কবি মাইকেল মধুসদন দত্তের ” মেঘনাদবধ কাব্যে ” এমনি মৃত্যু বেদনায় ব্যথিত এক পিতার করুন আর্তনাদ ! তা হচ্ছে, ভগ্নদূত মারফত রাবণের বীর সন্তান নিহত হওয়ার খবর শুনে পরাক্রান্ত রাজা রাবণকে ঝরঝর করে কাঁদতে দেখে মন্ত্রী সারণ রাজা রাবণকে বললেন, ” আপনি মহান এই বিশাল রাজ্যের অধিপতি, ধারক । পুত্রশোকে অশ্রুবিসর্জন কী আপনার সাজে ? বজ্রাঘাতে যদি পর্বতের শৃঙ্গ উড়েও যায়, তাতে কী পৃথিবী অস্থির হয় ? পর্বতের শৃঙ্গরূপ আপনার বীরপুত্র নিহত । কিন্তু তাতে আপনার কী বিচলিত হওয়া সাজে ! ” শুনে রাবণ বললেন, ” সবই বুঝি সারণ, সব অর্থহীন জানি, কিন্তু জেনেশুনেও মন যে কাঁদে, সেই জন্যই তো আমরা মানুষ ! হয় তো আমার গলায় বেদনার সুর ঐ কারণেই, আমরা মানুষ বলেই । ”
তাং- ২৪/০৫/২০১৯ইং
তারাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্•