রমজানে সিয়াম সাধনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইফতার। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইফতার সম্পর্কে বলেছেন, মুমিনের জন্য আনন্দের মুহূর্ত এবং এই সময় আল্লাহ রোজাদারের দোয়া কবুল করেন।
শরিয়তে ইফতার করা ও করানোকে ইবাদতের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আনন্দময় এই ইবাদত বিষাদে পরিণত হচ্ছে কিছু অর্থলোভী মানুষের জন্য। ইসলাম যাকে ইবাদত বলছে, সেই ইফতারকে জুলুম ও অবিচারে রূপ দিচ্ছে তারা। কিছু মানুষের লালসার কারণে সামাজিক ইবাদত ও উৎসবের পরিবর্তে ইফতার যেন সামাজিক ব্যাধি ও আতঙ্কে রূপ নিচ্ছে। বিশেষত বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়ের পরিবারের জন্য ইফতার এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। এসব অঞ্চলে ইফতার যৌতুক ও নির্যাতনের মাত্রায় নেমে এসেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, রমজানে দেশের বিশেষ কিছু অঞ্চলে অস্বাভাবিক রকমের ইফতারি পাঠানোর জন্য স্ত্রী ও তার পরিবারকে চাপ দেওয়া হয়।
এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর পরিবারের সামর্থ্যের চেয়ে স্বামীর পরিবারের প্রত্যাশাকে বড় করে দেখা হয়। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কোনো এলাকায় ছেলের শ্বশুরবাড়ির ইফতারি খাওয়াতে রীতিমতো প্যান্ডেল করা হয়। অভিযোগ আছে, সন্তোষজনক ইফতারি না পাঠালে নানা অশালীন মন্তব্য শুনতে হয় স্ত্রীকে। কোথাও কোথাও ইফতার-যৌতুক না পেয়ে নারীর ওপর নানাভাবে জুলুম ও নির্যাতন করে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।
গত ১৮ মে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে বাবার বাড়ি থেকে ইফতারি না আনায় এক গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। ১৮ মে বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, আট মাস আগে নিহত গৃহবধূ প্রিয়াংকার বিয়ে হয় আলাউদ্দিন নামের এক যুবকের সঙ্গে। ঘটনার রাতে বাবার বাড়ি থেকে ইফতারি ও ঈদসামগ্রী আনা নিয়ে ঝগড়া হয় তাদের। প্রিয়াংকার পরিবারের দাবি, তাঁকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে এবং এর সঙ্গে স্বামীর অন্য সদস্যরাও জড়িত। প্রিয়াংকার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এই ঘটনার পেছনে কতটা দায়ী তা আদালতই নির্ণয় করবেন। তবে নিঃসন্দেহে প্রিয়াংকার এই ঘটনা ইফতার-যৌতুকের ভয়াবহতা কোন পর্যায়ে রয়েছে তা সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এখান থেকেই আঁচ করা যায় ইফতার-যৌতুকের ব্যাধি সমাজের কত গভীরে শিকড় গেড়েছে এরই মধ্যে।
ইফতার ইবাদত। মুমিনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আনন্দের উপহার। সন্তুষ্টির সঙ্গে মানুষকে ইফতার করানো যেমন পুণ্যের কাজ, তাকে জুলুম ও আতঙ্কে পরিণত করাও ঠিক তেমনি নিন্দনীয়। সাধারণভাবে ইসলাম পরস্পরকে উপহার-উপঢৌকনে উৎসাহিত করে। সামর্থ্যানুযায়ী পরিবার মেয়ে-জামাইকে আদর-আপ্যায়ন করবে, তাদের সুদিনে-দুর্দিনে পাশে থাকবে এবং উপহার দেবে—এটা ইসলামের শিক্ষা। কেননা উপহার আন্তরিকতা বাড়ায় ও মনের কালিমা দূর করে। তবে উপহাররীতি যখন জুলুম ও সামাজিক অবিচারে রূপ নেয়, শরিয়ত তা কঠোরভাবে বর্জনের নির্দেশ দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরকে উপহার দাও, তোমাদের আন্তরিকতা বৃদ্ধি পাবে।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৫৯৪)
তবে রাসুলে আকরাম (সা.) উপহার আদান-প্রদানে স্বতঃস্ফূর্ত সন্তুষ্টির শর্ত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে উপহার খুশি মনে দেওয়া হয় সেটাই শুধু বৈধ।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২০৭১৪)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলিমের ওপর অন্য মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও সম্ভ্রম হারাম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)
এই হাদিস দ্বারা সামাজিকতা রক্ষার নামে জোরপূর্বক ইফতারি আদায়, এ জন্য খোঁটা দেওয়া, স্ত্রীর সম্মান নষ্ট করা এবং তার ওপর নির্যাতন করা নিষিদ্ধ প্রমাণিত হয়।
পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সন্তুষ্টির বাইরে সম্পদ গ্রহণকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ গ্রাস কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৮)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, এমন সব অপকৌশল আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে, যার মাধ্যমে মানুষের অসন্তোষ সত্ত্বেও তার থেকে অর্থ বা সম্পদ আদায় করা হয়। সুতরাং সামাজিকতা, উপহার বা অন্য যে নামেই ইফতারির বোঝা স্ত্রীর পরিবারের ওপর চাপানোর চেষ্টা করবে তা আল্লাহর দরবারে জুলুম বলেই বিবেচিত হবে এবং কিয়ামতের দিন এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও যৌতুক নিষিদ্ধ। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে যৌতুকবিরোধী আইন পাস হয়। সমস্যা হলো, নগদ অর্থ, আসবাব, গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদি প্রদানকে যৌতুক মনে করা হলেও ইফতার-যৌতুক, ঈদ-যৌতুক ও আম-কাঁঠালির মতো বিষয়গুলোকে সামাজিকতার মোড়কে আড়াল করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও যেন এ ব্যাপারে নির্বিকার। সামাজিকতার মোড়কে ইফতার-যৌতুক ও আম-কাঁঠালি যেভাবে সামাজিক অনাচারে পরিণত হচ্ছে এবং নানামাত্রিক অপরাধের কারণ হচ্ছে, তা এখনই রোধ করা আবশ্যক। তা না হলে এই ব্যাধি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর ক্ষত হয়ে দেখা দিতে পারে।সূত্র: কালের কন্ঠ