পুলিশের অভিযোগপত্র আবেদ আলী প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতা, জানা গিয়েছিল এক দশক আগেই

জাতীয়

এক দশক আগে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীকে প্রশ্নপত্র ফাঁস সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করেছিল থানা-পুলিশ। তখন সৈয়দ আবেদ আলীকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছিল।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, সাড়ে ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে আবদুর রহমান নামের এক পরীক্ষার্থীকে চাকরি দেওয়ার কথা পাকাপাকি করেন সৈয়দ আবেদ আলী। তিনি পিএসসির তৎকালীন সাঁটমুদ্রাক্ষরিক তারিকুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের সদ্য পাস করা শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার, নন-ক্যাডারসহ যাবতীয় পরীক্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিএসএসির অসাধু কর্মচারীদের সহায়তায় তা বাইরে নিয়ে আসেন। পরে মেধাবী ছাত্রদের দিয়ে উত্তরপত্র পূরণ করে সেটি পরীক্ষার এক ঘণ্টা বা আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠানো হয়।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, পিএসসির দুর্নীতিবাজ ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটিপতি বনে গেছেন; তাঁরা অযোগ্য, অদক্ষ লোকজনকে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার্থী সাজিয়ে অবৈধ পন্থায় পাস করিয়ে চাকরি দিয়ে আসছেন। পিএসসির সেই অশুভ চক্রের সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পাওয়া গেলে তাঁদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, পিএসসি দেশ ও জাতির একটা গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি জীবনের শুরু থেকে দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে থাকার সুবাদে অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এই সিন্ডিকেটের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে যোগদানের আগে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা ছিল; তাঁরা আজ সরকারি অনুমোদনক্রমে জমি, ফ্ল্যাটের ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি, অর্থ-সম্পদের মালিক বনে গেছেন। সৈয়দ আবেদ আলী সামান্য একজন কর্মচারী হলেও প্রতিবছর দেশের বাইরে ভ্রমণের অনুমতির ছুটিও পিএসসি তাঁকে দিয়েছে। যাতে পিএসসির কর্তৃপক্ষের অসতর্কতা বা উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পাবলিক পরীক্ষা আইনে করা মামলায় ২০১৪ সালে সৈয়দ আবেদ আলীসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় শেরেবাংলা নগর থানা-পুলিশ। পরের বছর (২০১৫ সালে) আবেদ আলীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। ৯ বছরে এ মামলার ১২ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র দুজন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে আবেদ আলীর বিচারও হয়নি। সেই সুযোগে পিএসসির না থাকলেও তিনি সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে বিসিএসসহ অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে এসেছেন।

 

৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ওই আবেদ আলী ও তাঁর ছেলে সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে পিএসসির দুজন উপপরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালকসহ পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেছেন, পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ তাঁর সিন্ডিকেট বিসিএস, নন–ক্যাডারসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত, সেটি ১০ বছর আগেই আদালতকে জানানো হয়েছিল। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অশুভ সিন্ডিকেটে পিএসসির আর যাঁরা জড়িত, তাঁদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত ছিল। যদি আবেদ আলীকে নজরদারির মধ্যে রাখা হতো, তাহলে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা পরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ পেতেন না।

এই মামলায় মঙ্গলবার আদালতে দায় স্বীকার করে আবেদ আলীসহ ছয়জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁদেরসহ গ্রেপ্তার সব আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এক দশক আগে পুলিশের চিহ্নিত প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের হোতার এত দিন এই অপকর্ম চালিয়ে আসার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদের। তিনি মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ তাঁর সিন্ডিকেট বিসিএস, নন–ক্যাডারসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত, সেটি ১০ বছর আগেই আদালতকে জানানো হয়েছিল। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অশুভ সিন্ডিকেটে পিএসসির আর যাঁরা জড়িত, তাঁদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত ছিল। যদি আবেদ আলীকে নজরদারির মধ্যে রাখা হতো, তাহলে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা পরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ পেতেন না।

আবেদ আলীর বিরুদ্ধে করা মামলায় এক দশকে মাত্র দুজন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করানোর বিষয়টিকে রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতার প্রচণ্ড ঘাটতি হিসেবে দেখছেন সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, এক দশক আগেই সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর সিন্ডিকেট বিসিএসসহ অন্যান্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত বলে যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়টি তাঁকে জানানো হয়নি। আবেদ আলীর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তিনি শিগগিরই পদক্ষেপ নেবেন।

পিএসসিতে আবেদ আলীর সিন্ডিকেট

এক দশক আগে (২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল) ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদের পরীক্ষা চলাকালে আবদুর রহমান নামের এক পরীক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ হাতেনাতে আটক করেন পরীক্ষকেরা। জিজ্ঞাসাবাদে রহমান জানান, বাইরে থেকে তাঁকে উত্তরপত্র সরবরাহ করেন পিএসসির তৎকালীন সাঁটমুদ্রাক্ষরিক তারিকুল। এ ঘটনায় পিএসসির নন-ক্যাডার (গোপনীয়) শাখার তৎকালীন সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে পরীক্ষার্থী আবদুর রহমানসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, ওই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বাইরে থেকে উত্তরপত্র লিখিয়ে আনার ঘটনায় জড়িত রয়েছেন আবেদ আলী।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, পরীক্ষার্থী আবদুর রহমানের মুঠোফোনের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানতে পারে, আবেদ আলী আবদুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে কথা বলেন। আবেদ আলী একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মোকসেদুল ইসলামের সঙ্গেও মুঠোফোনে কথা বলেন। পরে মোকসেদুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, পিএসসির সাঁটমুদ্রাক্ষরিক তারিকুল পরীক্ষার্থী আবদুর রহমানকে উত্তরপত্র সরবরাহ করেন। মামলার সাক্ষী পিএসসির তৎকালীন পরিচালক নাছিমা আক্তার ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, ‘পরীক্ষার্থী আবদুর রহমানকে লিখিত উত্তররপত্র সরবরাহের সময় পিএসসির কর্মচারী তারিকুল হাতেনাতে ধরাও পড়েন। ওরা প্রচুর ক্ষমতাবান। ওদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে।’

মামলার আরেক সাক্ষী পিএসসির তৎকালীন সহকারী পরিচালক শ্যামচরণ প্রামাণিক পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘সত্য কথা বলতে গেলে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বদলি খুব একটা হয় না। যাঁরা দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে কাজ করেন, যাঁদের টাকার লোভ-লালসা বেশি, তাঁরাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিসিএস, নন-ক্যাডারসহ বিভিন্ন পদে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ভার প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের। সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে যদি অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠানে অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হবে। এটাই স্বাভাবিক বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.