ঢাকা উড়ালসড়কের নকশা জটিলতা

বাংলাদেশ

সরকারি-বেসরকারি পদ্ধতিতে (পিপিপি) চলছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। রাজধানীর শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এই এক্সপ্রেস ওয়ের বিনিয়োগকারী ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইতাল থাই কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু প্রকল্পটি দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল অর্থায়নের অভাবে। এখন চায়না এক্সিম ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়নের কথা বলেছে। তবে প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের অ্যালাইনমেন্ট নিয়ে দুই বছর ধরে যে জটিলতা চলছে তা আজও সমাধান হয়নি। আবার হাতিরঝিল অংশে র‌্যাম্প স্থাপন না করার ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা আছে।

 

কিন্তু এ অংশে গাড়ি ওঠা-নামা করতে না পারলে লোকসান হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এ বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রকল্পের নকশা নতুন করে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ নিয়ে বৈঠকের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে সময় চাওয়া হতে পারে শিগগির। সেখানে হাতিরঝিলের র‌্যাম্প নিয়ে জটিলতার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে দ্রুত এটি সমাধানের অনুরোধ করা হতে পারে। বর্তমানে প্রকল্পের প্রথম পর্বের নির্মাণকাজ চলছে। বিনিয়োগকারীকে ইতোমধ্যে প্রথম অংশের জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। সংশোধিত চুক্তি অনুযায়ী এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দ্বিতীয় অংশ এবং ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তৃতীয় অংশের জমি বুঝিয়ে দিতে হবে বিনিয়োগকারীকে। তা না করতে পারলে বাংলাদেশ সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জরিমানা গুনতে হবে। এসব প্রসঙ্গ চিঠিতে উল্লেখ করে দ্রুত র‌্যাম্পের সমাধানের অনুরোধ করা হতে পারে সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে।

জানা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে লাইনের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে হাতিরঝিলের পানিতে উড়াল সড়কের র‌্যাম্প স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কারণ এতে হাতিরঝিলের সৌন্দর্যহানি ঘটতে পারে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত অটুট থাকলে আটকে যাচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। কারণ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বলছে, এর বিকল্প কোনো পথ নেই। পিলার হাতিরঝিলের দক্ষিণ দিকের পানিতেই পড়বে। এ লিংকটির জন্য অন্য কোনো বিকল্প অ্যালাইনমেন্ট পাওয়া যায়নি।

ওই লিংক বাদ দিলে প্রকল্পের ট্রাফিক ফোরকাস্টের ওপর মানে তাদের টোল বাবদ আয়ে প্রভাব পড়বে। সে ক্ষেত্রে চুক্তি সংশোধন করা লাগতে পারে। তাই বিয়াম এলাকা দিয়ে উড়াল সড়কটি নির্মাণ করতে হবে। এ নিয়ে সম্প্রতি বৈঠক করেছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সোনারগাঁও-বুয়েট লিংকের হাতিরঝিল এলাকায় সংশোধিত নকশায় দৃষ্টিনন্দন এবং পরিবেশবান্ধব কিছু বিষয় তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে।

এ নিয়ে প্রথমেই বলা হয়েছে-হাতিরঝিলের জলাধারের আয়তন না কমিয়ে দৃষ্টিনন্দনভাবে থাকবে পিয়ার ডিজাইন। পাশাপাশি হাতিরঝিল অংশে শব্দনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পান্থকুঞ্জ অংশে প্রস্তাবিত র‌্যাম্পটি বাদ দিতে হবে অথবা পার্ক যথাসম্ভব কম ক্ষতিগ্রস্ত করে নকশা করতে হবে। প্রস্তাবিত সোনারগাঁও-বুয়েট লিংকের র‌্যাম্পের মাধ্যমে সমতল (অ্যাট গ্রেড) রাস্তার বর্তমান সুুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না হাতিরঝিল প্রকল্পের পয়নিষ্কাশন পাইপলাইনও। প্রকল্পের টোল প্লাজাগুলোয় ইটিসি (র‌্যাপিড পাসের মাধ্যমে) ব্যবস্থা থাকতে হবে। একই সঙ্গে হাতিরঝিল অংশে টোল বুথ সংখ্যা কমিয়ে ডিজাইন করতে হবে, যাতে ওই অংশের থেকে সময় চাওয়ার কথা রয়েছে।

ডিটিসিএ সূত্র জানিয়েছে, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের সাংঘর্ষিক কিছু পিয়ার রয়েছে। বিশেষ করে কাকলী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সড়কের মিডিয়ানে ১৩টি পিয়ারের ওরিয়েন্টশন মিডিয়ান বরাবর না করে কোনাকুনি করা হয়েছে। বিআরটি রাস্তার মাঝখানে দুই লেন বরাবর থাকবে। অবশিষ্ট লেন দিয়ে চলবে সাধারণ যানবাহন। তাই উড়াল সড়কের পিয়ারের কারণে সাধারণ গাড়ি চলাচলের লেন সংকুচিত হবে। তাই বিআরটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ১৩টি পিয়ার রিডিজাইনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, এফডিসি গেটের সামনে মগবাজার ফ্লাইওভারের একটি পিয়ার আছে। তার পাশেই এক্সপ্রেসওয়ের ৫টি পিয়ার রয়েছে। এ পিয়ারগুলো থাকলে মেট্রোরেল এমআরটি-৫ (দক্ষিণাংশ)-এর টানেল ৪০ মিটার নিচ দিয়ে করতে হবে। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর ফলে হাতিরঝিল স্টেশন করা কঠিন হতে পারে। যদিও উড়াল সড়কের এ অংশে পিয়ার পরিবর্তন সম্ভব নয়। কারণ ইতোমধ্যে মগবাজার ফ্লাইওভারের কারণে এক্সপ্রেসওয়ের পিয়ার ৪০ মিটার করা হয়েছে। কারিগরি কারণে আর পরিবর্তন সম্ভব নয়।

এ নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ব্যয় বাড়লে আবার ব্যাংকের কাছে যেতে হবে। তাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও বিলম্বিত হতে পারে। তাই ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলো এ প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ডিজাইন করতে হবে। যেহেতু এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি বেসরকারি বিনিয়োগে হচ্ছে, তাই বারবার ব্যয় ও নকশা পরিবর্তন সম্ভব নয়। এর সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিষয়টিও তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয়েছে ওই বৈঠকে।

প্রকল্পের সার্বিক অবস্থা প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি তিনটি ধাপে সম্পন্ন হবে। প্রথম ধাপে এয়ারপোর্ট থেকে বনানী, দ্বিতীয় ধাপে বনানী থেকে মগবাজার ও শেষ ধাপে মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত কাজ হবে। আগামী জানুয়ারিতে সম্পন্ন হবে প্রথম ধাপের কাজ। আর পুরো কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের মার্চ মাসে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার আমাদের সময়কে বলেন, প্রকল্পের হাতিরঝিল অংশের র‌্যাম্প নিয়ে সমস্যা থাকায় বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। সেখানে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, স্থপতি ইকবাল হাবীব, ড. শামসুল হকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গুণীজনদের উপস্থিতিতে র‌্যাম্পের ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন। এটি এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে। সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে চায়না এক্সিম ব্যাংক থেকে ৪৬১ মিলিয়ন ডলার (৩ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা) এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি) থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারসহ (৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) সর্বমোট ৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকার ঋণচুক্তি করেছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।

গত ১১ জুন চায়না এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সেতু কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়েছে। তারা এ প্রকল্পে দ্রুত অর্থছাড়ের কথা জানিয়েছে। এ ছাড়া ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিনিয়োগকারী তথা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইতাল থাইয়ের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২৫ বছরের কনসেশন পিরিয়ডের মধ্যে সাড়ে তিন বছর ধরা হয় নির্মাণকাল হিসেবে।

প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে। এর প্রথম ধাপ ২০১৯, দ্বিতীয় ধাপ ২০২০ এবং তৃতীয় ধাপ ২০২২ সালে শেষের কথা রয়েছে। কিন্তু নকশা জটিলতার কারণে সময়মতো কাজ শেষ করার সংশয় কাটেনি এখনো।সূত্র: দৈনিক আলোকিত সকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *