চালে চাপা ধান!

বাংলাদেশ

ধান নিয়ে কৃষকদের সংকট বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা, সংসদীয় কমিটির নির্দেশনা, দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকদের কান্না—এসব কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না সরকারের খাদ্য বিভাগের। বরং খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে কদর বেশি মিলার ও চালের। শেষ পর্যন্ত কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার প্রক্রিয়া কোথাও কোথাও শুরু হলেও সামনে চলে আসছে খাদ্য বিভাগের নানা ধরনের কারিগরি সমস্যার অজুহাত। ফলে এই প্রক্রিয়াও খুব একটা সফল হবে—এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

 

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২৮ মার্চ খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে চলতি বোরো মৌসুমে ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত মোট ১২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করার কথা। এর মধ্যে রয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান (চালের আকারে এক লাখ মেট্রিক টন), ১০ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল এবং এক লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল। প্রতি কেজি ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২৬ টাকা। সিদ্ধ চাল প্রতি কেজি ৩৬ টাকা এবং আতপ চাল প্রতি কেজি ৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এবারের বোরো মৌসুমে ধানের ভালো ফলন হলেও নির্ধারিত সময়ে সরকারি পর্যায়ে ধান-চাল কেনা শুরু না হওয়ায় কৃষকরা ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। সে কারণে ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না তারা। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা গেছে। গতকাল বুধবার ঝালকাঠিতেও কৃষকরা বিক্ষোভ করে।

সম্প্রতি নড়াইলের সংসদ সদস্য ও জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার নির্দেশে নড়াইলে এবং অন্য কয়েকটি জেলায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

গত সোমবার খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কৃষক বাঁচাতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মন্ত্রণালয়কে বেশি ধান কেনার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরিফুর রহমান অপু গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে পারলে আমরাও খুশি হব। তবে এ ক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা হচ্ছে শুকনা ধানের ময়েশ্চার (আর্দ্রতা) মাত্রা না থাকা, মজুদ করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা না থাকা, পরিবহন খরচের ব্যবস্থা না থাকা, কেনা ধান আবার মিলারদের কাছে পাঠানো প্রক্রিয়ায় জটিলতা।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশের আবহাওয়াগত কারণেই গ্রামে অবাণিজ্যিক চাতালে ধান শুকালে তা প্রয়োজনীয় ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা পর্যন্ত শুকানো যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সর্বনিম্ন ১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত থাকে, যা আমাদের নির্দেশনার চেয়ে কম হয়ে যায়। আর ধান কমপক্ষে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত আর্দ্রতায় না শুকালে তা সংরক্ষণ করা কঠিন, গুদামে ওই ধান কিছুদিন রাখলে তা থেকে শেকড় গজিয়ে যায়। আবার মিলে ওই ধান ভাঙাতে দিলে তা ভেঙে যায়।’

গুদামের ধারণক্ষমতা সম্পর্কে মহাপরিচালক বলেন, ‘সারা দেশে আমাদের গুদামের ধারণক্ষমতা হচ্ছে ২১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য (ধান, চাল ও গম)। এখন মজুদ আছে ১২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। এবার আমাদের টার্গেট অনুসারে বোরো মৌসুমে আরো প্রায় ১৩ লাখ টন ধান-চাল কিনলে মজুদের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫ মেট্রিক টন। এতে মজুদ ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।’

এ কর্মকর্তা বলেন, ‘ধান কেনা হয় মূলত কৃষকদের স্বার্থেই। কারণ আমরা যে ধান কিনি সেটা আবার সরকারি গুদাম থেকে মিলারদের কাছেই পাঠাতে হয় ভাঙিয়ে চাল করে দেওয়ার জন্য। এ কাজে বাড়তি খরচও হয়। কারণ ধান তো আর মজুদ করে কোনো কাজে লাগে না।’

মাঠপর্যায়ে কোথাও কোথাও কৃষকদের কাছে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ধান কেনা শুরু করলেও সেটা গুদাম পর্যন্ত পরিবহনের খরচ নিয়ে দেখা দিয়েছে সমস্যা। পরিবহন খরচ কে দেবে জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘আমাদের নীতিমালা অনুসারে সেটা কৃষককেই দিতে হবে। কৃষকরাই ধান গুদাম পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ধান শুকানোর মাত্রা নিয়ে সমস্যা এবার নতুন নয়, আরো আগে থেকেই এই সমস্যা চলে আসছে। কিন্তু খাদ্য বিভাগের একটি চক্র ডিলারদের যোগসাজশে এই সমস্যা টিকিয়ে রাখতে নানাভাবে কারসাজি করে। বিশেষ করে ধান-চাল ক্রয় প্রক্রিয়ার শুরুর দিকে ধান না কিনে ধীরগতিতে কাজ শুরু করে। তত দিনে বৃষ্টি চলে আসে। বৃষ্টির কারণে একদিকে প্রয়োজনীয় একটানা রোদ পাওয়া মুশকিল হয়, অন্যদিকে মাটির চাতাল পানিতে ডুবে থাকে বা ভেজা থাকে। তখনই খাদ্য বিভাগের লোকজন ১৪ শতাংশ মাত্রার আর্দ্রতাসম্পন্ন ধান খুঁজতে নামে। কৃষকরা মান মাত্রার আর্দ্রতা রক্ষা করতে না পেরে কম দামে বাধ্য হয়ে ডিলার বা দালালদের কাছে ধান বিক্রি করে দেয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিশ্বজিৎ কর্মকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৪ শতাংশ মাত্রার আর্দ্রতাসম্পন্ন ধান শুকানোর মানমাত্রা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। বাংলাদেশ সরকার সেটাই অনুসরণ করছে। তবে এ ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কৃষি বিভাগের কর্মীদের উচিত কৃষক ওই মাত্রা অনুসরণ করে কিভাবে ধান শুকাতে পারে সেই কৌশল শিখিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া আধুনিক কৃষি-প্রযুক্তির আওতায় এখন দেশে মিনি ড্রায়ার পাওয়া যায়, সেটা কিভাবে কৃষকদের জন্য সহজলভ্য করা যায় তা নিয়েও ভাবা দরকার।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইসমত আরা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, কৃষকদের ধানের আর্দ্রতার জন্য চাপ দিয়ে লাভ নেই। বরং এমন একটা ব্যবস্থা চালু করা উচিত যেখানে সরকার বা তাদের অনুমোদিত লোকেরা কৃষকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দরেই ধান কিনে তারা আর্দ্রতা সংরক্ষণ করবে। মিলারদের কাছ থেকে সরকার তো সেভাবেই চাল কিনছে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মিলাররা কৃষককে ন্যায্য দাম দিচ্ছে না। সরকারের উচিত বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটর করা। এ ছাড়া ধানের মূল্য নির্ধারণে কৃষকদের মতামতকে গুরুত্ব দিলে এই পরিস্থিতি এড়ানো যায়।kalerkantho

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.