গুণী প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ হারালো বাংলাদেশ; কমরেড ডা. রমানাথ বিশ্বাস আর নেই।

ঢাকা বিভাগ গোপালগঞ্জ

মানবতা তথা প্রগতিশীল চিন্তাধারার ধারক ও বাহক গোপালগঞ্জের বাম
রাজনীতির পুরোধা মুক্তিযোদ্ধা ডা. রমানাথ বিশ্বাস পরলোকগমন
করেছেন। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে
তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। গত ২ অক্টোবর
বিকেলে গোপালগঞ্জ শহরের নিজবাড়িতে তিনি পড়ে গিয়ে মাথায়
গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে
সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে গোপালগঞ্জ আড়াইশ’ বেড জেনারেল
হাসপাতাল থেকে গাজীপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব
মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
মঙ্গলবার সকালে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রæত তাকে এভার কেয়ার
হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ তাঁর মৃত্যুর খবর
নিশ্চিত করেন। বেশকিছুদিন ধরে তিনি শারিরীক নানা জটিলতায়
ভ‚গছিলেন।
জেলা বিএমএ, কমিউনিষ্ট পার্টী, উদীচী, কেন্দ্রীয় সার্বজনীন
কালীবাড়ি ও খাটরা সার্বজনীন কালীবাড়িসহ বিভিন্ন সামাজিক,
সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাঁর মৃত্যুতে গভীর
শোক প্রকাশ ও শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন
করেছেন।
বুধবার সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জ পৌর-পার্কে তাঁকে রাষ্ট্রীয়
মর্যাদা দেয়া হবে। এরপর পৌর-মহাশ্মশাণে তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত
হবে।
৫২’র ভাষা আন্দোলন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রমানাথ
বিশ্বাস ছাত্রজীবনেই জড়িয়ে পড়েন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির
সঙ্গে। ১৯৬০ সালে ঢামেক থেকে এমবিবিএস পাশ করে কিছুদিন
সেখানেই গাইনী বিভাগের এসিস্ট্যান্ট সার্জন হিসেবে ছিলেন।
পরে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালেও এসিস্ট্যান্ট সার্জন
হিসেবে চাকুরী করেন। ১৯৬২ সালে তিনি সাব-ডিভিশনাল

মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে দিনাজপুরে যোগ দেন। পরের বছরই বদলী
হয়ে আসেন গোপালগঞ্জ মহকুমা হাসপাতালে। এসেই তিনি
পাকিস্তান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন গোপালগঞ্জ মহকুমা শাখার
সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এরইমধ্যে মাওলানা ভাসানীর
মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দেন ভাসানী ন্যাপে। ১৯৬৮ সালে তিনি
পটুয়াখালীতে বদলী হলে এলাকার মানুষের চিকিৎসার কথা ভেবে চাকরি
ছেড়ে গোপালগঞ্জেই প্রাইভেট প্রাকটিস শুরু করেন। ওই বছরই
তিনি ন্যাপ ’এর গোপালগঞ্জ মহকুমা সভাপতির দায়িত্বভার পান। সে
দায়িত্ব পালন করেন দু’ যুগেরও বেশি। তাঁর সৌজন্যবোধ ও
সহানুভ‚তিশীলতায় স্বাধীনতাপূর্ব গোপালগঞ্জের রাজনীতিতে বাম
রাজনীতি এক অনন্য মাত্রা পায়। প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনায় মানুষকে
উজ্জীবিত করার কারণে তিনি সত্তরের দশকে মৌলবাদের রোষানলেও পড়েন।
তারপরও বিশ্বজনীন মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে মানব-ধর্ম প্রতিষ্ঠায়
তিনি নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছেন।
কমরেড মনি সিং, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, প্রফেসর
মোজাফ্ধসঢ়;্ধসঢ়;ফর আহম্মেদ, সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত ও পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য সহ বহু
কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সান্নিধ্য ও আনুকুল্য পেয়েছেন তিনি।
গোপালগঞ্জের এ্যাড. সরদার নওশের আলী, এ্যাড. নুরুজ্জামান খোকন,
কমরেড আবু হোসেন, ওয়ালিউর রহমান লেবু মিয়া, কমলেশ বেদজ্ঞ,
শওকত চৌধুরী, রেফাউল হক মঞ্জু, লুৎফর রহমান গঞ্জর, রবু খান, প্রমুখ
ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা।
বঙ্গবন্ধু ’র ৭ই মার্চের ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের
ট্রেনিং নিয়েছেন। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি ওপার বাংলার বনগাঁ
সাব-ডিভিশনাল হাসপাতালে শরণার্থীদেরকে চিকিৎসা দানের
পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন। সে সময় তাঁর প্রদত্ত
ফিটনেস সার্টিফিকেটধারীরা বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলা
প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে তিনি ন্যাপ
(মোজাফ্ধসঢ়;ফর) এর প্রার্থী হিসেবে পার্লামেন্ট নির্বাচণে অংশ
নেন। সামান্য ভোটের ব্যবধানে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোল্লা
জালাল উদ্দীন আহম্মেদের কাছে হেরে যান।
মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে
স্ব-পরিবারে হত্যার প্রতিবাদে গোপালগঞ্জের বাম সংগঠনগুলোর
প্রতিটি আন্দোলনে তিনি ভ‚মিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর
অবহেলিত জনপদ গোপালগঞ্জের মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি তাঁর
রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন।

৮০’র দশক পর্যন্ত গোপালগঞ্জে দু’জন এমবিবিএস ডাক্তারের তিনি
একজন। রাত-বিরেতে তিনি দূর-দূরান্তে ছুটে গিয়েছেন অসুস্থ
মানুষের পাশে। কেউ চিকিৎসা-ফি দিতে না পারলে তাকে ঔষধ কিনে
দিয়ে যাতায়াত ভাড়াও দিয়ে দিতেন। তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত
পাকিস্তান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের গোপালগঞ্জ মহকুমা
শাখার সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সহ-সভাপতি
ছিলেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত তিনি জেলা বিএমএ’র সভাপতির
দায়িত্ব পালন করেন।
ডা. রমানাথ বিশ্বাস ছিলেন সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সার্বজনীন
চেতনার পৃষ্ঠপোষক। বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যাপক (বাংলা) মহেন্দ্রলাল
বিশ্বাস সহ গোপালগঞ্জের সাহিত্যপ্রেমী সুশীল সমাজ নিয়ে
মধুচক্র সাহিত্য সভা নামে একটি সংগঠন গড়েছিলেন।
সার্বজনীন অনুষ্ঠান পালনে তাঁর ছিল বিশেষ আগ্রহ। বিভিন্ন পত্র-
পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ছাপা হয়েছে। স্বামীজির মানব-
ধর্ম পালনের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ অনুরাগ। মানবতাবাদকে
প্রাধান্য দিয়ে তিনি ২০০৯ সালে ‘মানব ধর্ম’ নামে দু’খন্ডের
একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। এক যুগেরও বেশী সময় ধরে তিনি
গোপালগঞ্জ কেন্দ্রীয় সার্বজনীন কালীবাড়ি মন্দির কমিটির সম্পাদক
ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের চিকিৎসা-সেবাদানসহ জীবনের দীর্ঘ
পথ-পরিক্রমায় স্বাস্থ্য-সেবায় সুদীর্ঘ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ
গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ, জেলা ইউনিট কমান্ড ও বিএমএ ’এর পক্ষ
থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনি সম্মাননা পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *