প্রতিষ্ঠার ৯ বছরে এসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় চরম সংকটে পড়েছে। উপাচার্যসহ শীর্ষ ১২ পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ সংকটে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। সেমিস্টার ও ফাইনাল পরীক্ষা না হওয়ায় বাড়ছে সেশনজট।
এছাড়া অর্থের অভাবে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের প্রথমবর্ষ স্নাতকের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এখন শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন বন্ধের আশঙ্কা করছেন। সংকট উত্তরণে সংশ্লিষ্টরা উপাচার্যসহ শীর্ষ পদে দ্রুত নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ মাস উপাচার্যসহ শীর্ষ ১২ পদে কেউ না থাকায় পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাভাবে বিআরটিসিকে সেপ্টেম্বরের বিল না দিতে পারায় নিয়মিত গাড়ি চলা নিয়ে সন্ধিহান। একই কারণে গত ১৪ অক্টোবর ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা হয়নি। উন্নয়নসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে।
আন্দোলনের মুখে উপাচার্য ড. এসএম ইমামুল হক বিদায় নিলেও পাঁচ মাসেও নিয়োগ হয়নি। উপ-উপাচার্য হাল ধরবেন।
কিন্তু প্রতিষ্ঠা থেকেই এ পদে কেউ নেই। আপদকালীন কিছুদিন উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করলেও ট্রেজারার এ কে এম মাহবুব হাসান ৭ অক্টোবর মেয়াদ শেষ করেছেন। পরের শীর্ষ ব্যক্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ফজলুল হক ৩ অক্টোবর শেষ কর্মদিবস পার করেন। নারীঘটিত কারণে বরখাস্ত হওয়ায় রেজিস্ট্রার পদও এখন শূন্য। গত ৫ আগস্ট কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মাদ মুহসিন উদ্দিন মেয়াদ শেষ করেছেন। তিনি জানান, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. হাসিনুর রাহমান তিন মাসের বেশি চিকিৎসা ছুটিতে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের একটিতেও এখন ডিন নেই। লাইব্রেরিয়ান মোহাম্মাদ শাহাজুল ইসলাম চাকরি ছেড়েছেন। দীর্ঘদিন উপাচার্য না থাকায় সিন্ডিকেট, অর্থ কমিটি ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সভা হচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে আরও জানায়, ৪৪ অধ্যাপকের ৪২টি এবং ৬৬ সহযোগী অধ্যাপকের সবকটি শূন্য। ২৪১ প্রভাষকের জায়গায় আছেন মাত্র ৯৫ জন। আর সহকারী অধ্যাপক ৯৭ জন। প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য সবমিলে ১৯৪ শিক্ষক থাকলেও, তাদের ৪৪ জনই চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন ও শিক্ষা ছুটিতে। ফলে বর্তমানে উপস্থিত ১৫৬ শিক্ষক দিয়ে কোনোরকম খুঁড়িয়ে চলছে পাঠদান।
এর সঙ্গে রয়েছে শ্রেণিকক্ষ সংকট। মাত্র একটি শ্রেণিকক্ষে লোকপ্রশাসন, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, হিসাববিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বেশ কয়েকটি বিভাগে ৭/৮টি ব্যাচের ক্লাস হয়। বাকি তিনটি শ্রেণিকক্ষে দুটি বিভাগ ভাগাভাগি করে ক্লাস নেয়। বিকল্প হিসেবে টিএসসিতে ক্লাস নেওয়া হয়।
এসব সংকটের জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগের শিক্ষার্থী দীর্ঘ সেশনজটে পড়েছেন। ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থীদের ২০১৮ সালে মাস্টার্স শেষ করার কথা থাকলেও মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ কেবল অনার্স পরীক্ষা নিয়েছে। ফল কবে, তার ঠিক নেই। ২০১৪-১৫ সেশনেও একই অবস্থা। সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজি, লোকপ্রশাসন, আইন, মার্কেটিং, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ অধিকাংশ বিভাগেই ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি সেশনজট।
মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) আঞ্জুমান আরা রজনী বলেন, ‘বিগত সেশনের জট কমাতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। সামনে যাতে না হয়, সেজন্য কাজ হচ্ছে। কিছুটা সময় লাগলেও সমস্যা সমাধান হবে। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলের নিজস্ব গাড়ি আটটি। পাঁচটি ডাবল ডেকার, দুটি একতলা গাড়ি বিআরটিসি থেকে ভাড়ায় চালানো হয়। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের বিল দিতে পারেনি প্রশাসন। পরিবহন পুলের ব্যবস্থাপক মো. মেহেদি হাসান বলেন, ‘উপাচার্য না থাকায় বিল পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। নিয়মিত গাড়ি চালানো নিয়েই আমরা চিন্তায় আছি। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিরও বেহাল দশা। ৩১ হাজার ৪০০ ই-জার্নাল ও ১ লাখ ১২ হাজার ই-বুক থাকলেও কম্পিউটার ল্যাবে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন বিভাগেরই ৫০টির বেশি বই নেই। কয়েকটি বিভাগীয় ল্যাবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকলেও অধিকাংশ বিভাগই ধারদেনা করে ল্যাবের কাজ করছে।
গন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মোঃ সোহেল রানা বলেন‘বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থা কখনো কাম্য নয়। বর্তমানে ভার্সিটির দেখাশোনা করার কেউ ই নেই । কর্মচারীবৃন্দ যে যার মত চলছে। এভাবে ভার্সিটি চলতে পারেনা। দ্রুত ভিসি নিয়োগ দিতে হবে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সিরাজিস সাদিক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় চরম ক্রান্তিকাল পার করছে। দ্রুত উপাচার্য বা ট্রেজারার নিয়োগ না হলে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসন বলতে যা বোঝায়, এখন তা নেই।