‘এদেশে অনেক লোকের মেরুদণ্ড নেই’- বলে মন্তব্য করেছেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তিনি বলেন, আমাদের নৈতিকতার মান এত দুর্বল হয়ে গেছে যে প্রচুর আসামী আছে কিন্তু বাদী পাওয়া যায় না। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার সুমন এসব কথা বলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুকে চারপাশের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে লাইভে এসে কথা বলে আলোচনায় এসেছেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। হাইকোর্টের এ আইনজীবী মনে করেন, এ প্রজন্মের সামনে বড় বাধা হিংসা। হিংসার জন্য কেউ কাউকে উঠতে দিতে চায়না। এভাবে কেউ কাউকে উঠতে না দিলে দেশটাই একদিন শেষ হয়ে যাবে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আপনি আগে ছিলেন শুধু ব্যারিস্টার। এখন আপনি একজন মানবাধিকার কর্মী, সমাজসেবক। আপনি যতোই কাজ করছেন মানুষ ততোই আপনাকে চিনছে। আপনাকে নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা বাড়ছে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন : ব্যারিস্টারি পাশ করার পর আমার অনেক সুযোগ ছিল লন্ডনে থেকে যাওয়ার। কিন্তু তবুও আমি মাটির টানে ফিরে আসি। আমি উপলব্ধি করছিলাম, এখন আমি দেশকে কিছু দেওয়ার সময়। আমি বড় হয়েছি এ মাটিতে। যা কিছু পেয়েছি এ মাটি থেকে। এখন যদি অন্যদেশে গিয়ে নিজের মেধা প্রয়োগ করি- এ ব্যাপারটা মানতে পারছিলাম না। নিজের বিবেক, নীতি নৈতিকতার সাথে তা যাচ্ছিল না। এজন্যই দেশে ফিরে আসা।
আসার পর চেষ্টা করেছি, নিজের সাধ্যের ভেতরে যতোটুকু পারা যায় মানুষের সেবা করা। একটা সময় আসল যখন নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েও চেষ্টা করেছি। যা ছিল সব দিয়েছি। এ পর্যন্ত চব্বিশটা ব্রীজ বানিয়েছি নিজের টাকা দিয়ে। আমার উপলব্ধি হয়েছে মানুষের সেবা করার জন্য আমি খুব বেশী সময় নাও পেতে পারি। এমনো হতে পারে, কয়দিন পর আমি খুব স্বার্থপর হয়ে যেতে পারি। কয়দিন পর আমি বেঁচেও না থাকতে পারি। যদি কিছু না করি, নিজের বিবেকের কাছে কী জবাব দিব?
এখন যখন প্রশংসা পাই, সত্যি কথা অনুপ্রাণিত হই। নতুন করে আরো কিছু করার তাগাদা অনুভব করি। আবার মাঝে মাঝে দুঃখও হয়। ভাবি, যদি আরো অনেকে আমার মতো করে এগিয়ে আসত তাহলে দেশে আরো বেশী কাজ হত। দেশটা তাড়াতাড়ি পাল্টানো সম্ভব হতো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আপনি ব্রীজ বানাচ্ছেন, ময়লা সরাচ্ছেন, রাস্তার মাঝখান থেকে খুঁটি সরাচ্ছেন। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, এ প্রজন্মের সামনে বড় প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী- অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে কী বলবেন?
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন : এ প্রজন্মের সামনে বড় প্রতিবন্ধকতা হিংসা। এই হিংসার কারণে একজন আরেকজনকে উঠতে দেয় না। যিনি উঠতে দিতে চান না তার বুঝা উচিত, উঠতে না দিতে দিতে একদিন দেশটাই থাকবে না।
আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো, আমাদের নৈতিকতার জায়গা এত দুর্বল হয়ে গেছে অনেক লোকেরই মেরুদন্ড নাই। এদেশে এখন অনেক আসামী পাওয়া যায় কিন্তু বাদী পাওয়া যায় না। একজন শক্ত বাদীর বড় অভাব। যিনি দাঁড়িয়ে বলবেন আমার বিরুদ্ধে অন্যায় হয়েছে। আমি বিচার চাই। আমি আমার অধিকার চাই, বিচার চাই- এই চাওয়ার মতো লোকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
এটা এ প্রজন্মের সামনে বড় প্রতিবন্ধকতা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আপনি কয়েকদিন আগে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, এদেশে সাহসী মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। কেন?
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন : সাহসী লোকের সংখ্যা এমনিতে কমছে না। বিভিন্ন জায়গায় দুর্নীতি, বিভিন্ন জায়গায় অন্যায়ের সাথে আপোষ। বিভিন্ন জায়গায় সৎ লোকগুলোকে দাবিয়ে রাখা হয়। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় অসৎলোক বা দুর্নীতিবাজরা প্রমোশন পাচ্ছে। এর ফলে আস্তে আস্তে সৎ লোকের সংখ্যা কমছে। সত্য কথা বলার মানুষগুলো নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এটা একটা কারণ। যে গাছটাকে আপনি বাড়তে দিবেন না, পানি দিবেন না, যত্ন নিবেন না সেই গাছটা একটা সময় গিয়ে ফল দিবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আপনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেন, ভাল কিছু করার তাগাদা ভেতর থেকে আসতে হয়। তরুনদের ভেতর থেকে এই তাগাদা আনার জন্য কী কিছু করা যায়?
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন : এ ব্যাপারে বাবা মায়ের দায়বদ্ধতা বেশী। সন্তানের ছোটবেলা থেকে তারা এ ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা যদি ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের শিক্ষা দেন অন্যের অধিকার হরণ করতে হয় না, অন্যের কোন ক্ষতি করতে হয় না, অন্যের অধিকার ছিনিয়ে এনে নিজের পরিবারের লোকজনকে দিতে হয় না, তাহলে বিধাতা তোমার উপর বিরাগভাজন হবেন- এগুলো বলতে বলতে একটা বাচ্চার মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রভাব পড়বে। ফলে বড় হয়ে সে কোন অন্যায় করতে গেলে তার বিবেকে বাঁধবে। মা যখন কোন বাচ্চাকে বলে তখন এটার প্রভাব অনেক বেশী। মা যদি বাচ্চাকে শেখায়, কারো জিনিস না বলে নিতে হয় না। নিলে সেটাকে চুরি বলে। জোর করে কারো কিছু নিতে হয় না। সেটা মহা অন্যায়। অামি মনে করি এমন শিক্ষা সমাজটাকে অনেক খানি এগিয়ে নিতে সক্ষম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : এদেশের বিচার ব্যবস্থা খুব ধীরগতিময়। অনেক নীরীহ লোক বিনা বিচারে ফেঁসে যায়, জেল খাটে। দৈনন্দিন জীবনের এমন অভিযোগগুলোর জবাবে আইনজীবী হিসেবে কী বলবেন?
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন : এ অভিযোগগুলো পুরোপুরি সত্য। অস্বীকার করছি না। তবে ব্যাপারটার জন্য শুধু আইনজীবীরা দায়ী নয়। এখানে পুলিশ বিভাগ আছে, বিচার বিভাগ আছে। সবকিছু মিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এখানে একধরনের জটিলতা তৈরী হয়েছে। শুধুমাত্র আইনজীবীদের সদিচ্ছা দিয়ে এর পরিবর্তন সম্ভব নয়। বরং পুরো প্রক্রিয়াটাকে ঢেলে সাজানো উচিত। আমি মনে করি একজন নৈতিকতাসম্পন্ন আইনজীবী কখনোই তার সক্ষমতার বাইরে গিয়ে ক্লায়েন্টকে কষ্ট দিকেন না বা দিতে চাইবেন না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আমাদের দেশে একটা সংস্কৃতি চালু আছে। আমরা যে কোন কিছুর জন্য রাজনীতিবিদদের দোষ দিয়ে থাকি। আমরা মনে করি সকল অসঙ্গতির পেছনে রাজনীতি। আপনি কী একমত?
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন : না, সব দোষ রাজনীতিবিদদের উপরে চাপানোর পক্ষপাতি আমি নই। আবার তাদেরকে ছেড়েও দিচ্ছি না। তারা একটা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে রাজনীতিবিদদের সাথে সাথে আমরা যারা অন্যান্য পেশার লোক আছি, সবাইকে যে যার জায়গা থেকে জবাবদিহিতা করতে হবে। যে যার কাজটুকু করা লাগবে। সব রাজনীতিবিদদের উপরে চাপিয়ে দিলে হবে না। একজন নাগরিক হিসেবে আপনি যদি আপনার দায় দায়িত্বের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান না হন তাহলে অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হবেন কীভাবে? আপনার জায়গা থেকে আপনি শুরু করুন। দেখবেন সবাই সবার জায়গা থেকে আস্তে আস্তে শুরু করতে বাধ্য হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : তরুনদের জন্য কিছু বলুন।
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন : দেশের মোট জনসংখ্যার দিক থেকে তরুনরা সংখ্যাগরিষ্ট। যাদের বয়স পনের থেকে চল্লিশের মধ্যে। তরুন নিয়ে আমি আশাবাদী। তাদের বলব, চলুন আমরা এক হই। দলমত নির্বিশেষে দেশের জন্য কাজ করি। দেশের জন্য আমরা সবাই এগিয়ে আসলে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলার কেউ থাকবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : এই যে আপনি এক হওয়ার জন্য বলছেন, এখানে কিন্তু নেতৃত্বের একটা প্রশ্ন আছে। আপনি কী মনে করেন নেতৃত্বের দিক থেকে আমরা পরিপূর্ণ?
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন : সংখ্যায় কম। বিশ্বাস স্থাপন করার মতো নেতার সংখ্যা কম। জায়গায় জায়গায় নেতৃত্বের ঘাটতি আছে। সেই ঘাটতি পূরণেও তরুনদের এগিয়ে আসতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আপনি ছোটবেলায় প্রচুর ফুটবল খেলতেন। এরপরও আপনি আজকে সফল আইনজীবী। এখনকার বাবা মায়েরা মনে করেন সফল হতে হলে খেলাধূলা বাদ দিতে হবে। আপনি কী বলেন?
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন : আমি মনে করি, যে যেটা হোক না কেন তাকে অবশ্যই সুস্থ শরীরের অধিকারী হতে হবে। সুস্থ শরীরের জন্য মাঠে যেতে হবে। অবশ্য এখনতো মাঠ নেই। যাবেই বা কোথায়? কম্পিউটার গেম খেলে চোখ নষ্ট করা ছাড়া অার কিছু সম্ভব নয়। বাবা মায়েরা শর্টকাট ওয়েতে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ব্যারিস্টার চান। তারা বুঝতে চান না শর্টকাট ওয়েতে এটা সম্ভব না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার যাই হোক না কেন অাগে তাকে সুস্থ হতে হবে। শারীরিক ভাবে ফিট হতে হবে। এজন্য তাকে খেলতে দিতে হবে।
আমাদের দেশে এখন মাঠই নেই। সামাজিক অবস্থাও অস্থির। ফলে বাবা মাকে দোষ দিয়ে কী লাভ। এরপরও বলব তাদের বাইরে যেতে দিন। খেলতে দিন। সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন নিয়ে বড় হলে তাদের দিয়ে দেশ উপকৃত হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : আপনাকে ধন্যবাদ।
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন :আপনাকেও ধন্যবাদ। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের জন্য শুভকামনা।