রাবেয়া আক্তার
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মেঘনা।
প্রাথমিক শিক্ষাকে শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের মূল হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। আর এই ভিত্তিকে মজবুত ও টেকসই করে গড়ে তোলার মূল কারিগর শিক্ষক ও অভিভাবক। বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কাজটি মূলত শিক্ষকেরাই করে থাকেন। তাহলে অভিভাবকের কী ভ’মিকা এ বিষয়টি নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
শিক্ষক তার পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও আন্তরিকতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে, শিক্ষায় ব্যবহৃত আধুনিক বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে শ্রেণিকক্ষে ছকে বাঁধা ৪০-৫০ মিনিটের একটি পাঠ দিয়ে থাকেন। সেখানে থাকে পড়ো, লিখ, যোগ করো, বিয়োগ করো ইত্যাদি বিষয়। এর বাইরে শিক্ষকদের আরো অনেক কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ খুবই সামান্য। এজন্য নেপথ্যের কারিগর হিসেবে হাল ধরতে হবে অভিভাবকদেরই।
ভিত্তি মজবুত করার জন্য কারিগর যেমন দক্ষ হতে হয়, তেমনি ব্যবহৃত দ্রব্যাদির গুনগত মানও ভালো হতে হয়। আর এদিকটা খেয়াল রাখার মূল দায়িত্ব মালিকের, কারিগরের নয়।
শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু জ্ঞানার্জনই নয়, একজন মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন।এই পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন যেন একজন শিক্ষার্থীকে স্মার্ট বাংলাদেশের দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। আর এর জন্য মূল ভূমিকা পালন করতে হবে অভিভাবকেই।
প্রথমত, যে বিষয়টির প্রতি অভিভাবকদের নজর দিতে হবে, তা হলো সাধ্যের মধ্যে সন্তানের জন্য পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা করা। একদিন বেশি পরিমানে খাওয়ানো, তারপর দীর্ঘ বিরতি যেন না হয়। কম হোক, নিয়মিত খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
অনেক সময়ই শিশুরা সকালে না খেয়ে বিদ্যালয়ে আসে। পেটে ক্ষিদে নিয়ে কি পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া যায়? দিনের পর দিন এই অবস্থা চলতে থাকলে শিশু মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে এবং স্বাভাবিক শরীর গঠন ব্যাহত হবে। এছাড়াও পুষ্টিহীনতা, নানা রকম অসুখ-বিসুখ, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেবে।
শিশুরা স্বভাবতই একটু বেখেয়ালী। সারাদিন খেলাধুলা এবং ছোটাছুটি করতেই তারা বেশি পছন্দ করে। পানির পিপাসা লাগার পরও তারা পানি পান করেনা। এজন্য অভিভাবকেই খেয়াল রাখতে হবে শিশু সারাদিন পর্যাপ্ত পানি পান করলো কিনা। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠা, সকাল এবং রাতে দাঁত ব্রাশ করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে। খাওয়া, খেলাধূলা, ঘুম,পড়াশোনা ইত্যাদি কাজ রুটিন মাফিক হওয়া খুবই জরুরি। এ থেকে শিশুরা শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতা শিখবে।
স্মার্টফোনসহ নানা ধরণের ইলেকট্রনিক ডিভাইস শিশুদের স্বর্ণময় সময়ের বড় একটা অংশ কেড়ে নিচ্ছে। চোখের এবং ব্রেইনের ক্ষতি করছে। মানসিক অস্থিরতা তৈরি করছে। এর থেকে শিশুকে দূরে রাখার দায়িত্ব অভিভাবককেই নিতে হবে। না পারলে সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে।
রাত-বিরাতে অনিয়ন্ত্রিত ও অবাধ্য চলাফেরা, বখাটে বন্ধুদের সাথে আড্ডাই কিশোর অপরাধের প্রথম সোপান। এই অপরাধ বর্তমান সময়ে ভয়ানক রূপে নিচ্ছে। সন্তানের গতিবিধি সম্পর্কে অভিভাবকদের শুধু খেয়াল রাখলেই চলবে না, নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে হবে। নির্দিষ্ট কারণ বা প্রয়োজন ব্যতিত সন্ধ্যার পর শিশু যেন বাইরে না যায় এবং পড়ার টেবিলে বসে কী পড়ে, এসব বিষয়েও নজর রাখতে হবে।
উল্লিখিত কাজগুলোর সবগুলোই বাবা-মা বা অভিভাবকের। শিক্ষকেরাও যে এসব বিষয়ে কোনো ভ’মিকা রাখতে পারেন না বা রাখেন না এমন নয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলো শ্রেণিকক্ষে প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষকেরা তাদের শিক্ষার্থীদের বলে থাকেন, বুঝিয়ে থাকেন। কিন্তু শিশু তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই গুরুত্ব অনেক সময় অনুধাবন করতে পারেনা। শিশু যখন ধীরে ধীরে বড় হবে তখন সে এসব বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে এবং নিজের প্রতি যতœবান হবে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত, শিক্ষক এবং অভিভাবক মিলে, শিশুর শারিরীক এবং মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য এই বিষয়গুলোর প্রতি সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়ার বিকল্প নেই। শিক্ষক পরামর্শ দেবেন, আর অভিভাবক বাস্তবায়ন করবেন। শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যত ধনী কিংবা দরিদ্রের উপর নির্ভর করেনা, নির্ভর করে সন্তানের প্রতি অভিভাবকের যতœশীলতা এবং দায়িত্বশীলতার উপর। বাবা মায়ের অবিরত অর্থ ব্যয়, অক্লান্ত চেষ্টা, স্বপ্ন সার্থক হওয়া নির্ভর করে সন্তান সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার উপরই। তাই সব দায়িত্ব শিক্ষকের উপর ছেড়ে না দিয়ে গুরু দায়িত্ব পালন করা উচিত অভিভাবকেরই।