পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও ৫৬০৯ গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করছে না দেশের ৫ জীবন বীমা কোম্পানি। গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বায়রা লাইফ, সানলাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ এবং সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এ কাজ করছে। টাকার দাবিতে গ্রাহকরা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থায় অভিযোগ করেছেন।
জমানো টাকা ফিরে পেতে প্রতিদিনই তারা আইডিআরের অফিসে ভিড় করছেন। সর্বশেষ কোম্পানিগুলোকে টাকা পরিশোধের জন্য সর্বোচ্চ দুই মাস দেয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিগুলোর মালিকরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) নেতৃত্বেও আছেন এরা। তাই তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে আইডিআরের নির্বাহী পরিচালক ড. রেজাউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কয়েকটি কোম্পানি গ্রাহককে পলিসির টাকা দিচ্ছে না। সম্প্রতি এ ব্যাপারে আইডিআরের কাছে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। কোম্পানিগুলো টাকা না দিয়ে বিভিন্ন ভাবে গ্রাহককে হয়রানি করছে।
বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ গ্রামের গরিব মানুষ খুব কষ্ট করে টাকা জমা দিয়েছে। মেয়াদ শেষ হলেও কোম্পানিগুলো তাদের টাকা দিচ্ছে না। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা প্রতিটি কোম্পানির সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে কঠোর বার্তা দিয়েছি। আর টাকা পরিশোধের সময়ও বেঁধে দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে বাধ্য হয়েই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আইডিআরের তথ্য অনুসারে, ৫ কোম্পানির বিরুদ্ধে ৫৬০৯ গ্রাহককে পলিসির টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগ জমা পড়েছে। এ ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেসব নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছে পৌঁছাতে পারেনি, সে সংখ্যা হিসাব করলে তা ২০-২৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। যেসব কোম্পানি গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করছে না, এর মধ্যে প্রথম অবস্থানে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
আইডিআরের কাছেই ২ হাজার ৩৪৪টি অভিযোগ রয়েছে। পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও বছরের পর বছর তারা গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করছে না। এসব পলিসির বিপরীতে সুদ ছাড়া টাকার পরিমাণ ৩ কোটি। কিন্তু সুদসহ হিসাব করলে তা কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
এ ছাড়াও আইডিআরের বাইরে থাকা অভিযোগ তদন্ত করলে বিশাল আকারে পৌঁছাবে। জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার মালিকানাধীন বায়রা লাইফের বিরুদ্ধে ১ হাজার ২৯৪ জন গ্রাহকের অভিযোগ জমা পড়েছে। ইতিমধ্যে কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে।
তবে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। আইডিআরের তদন্ত অনুসারে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির কাছে মোট ৮ হাজার ২৩৭ জন গ্রাহক অভিযোগ করেছেন। এ নিয়ে কোম্পানিকে ১৩টি চিঠি দেয়াসহ ২টি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ১ হাজার ৬১০ জন গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করেছে। এরপরও ৬ হাজার ৬২৭ জন গ্রাহকের টাকা পরিশোধ হয়নি।
তবে আইডিআরের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে ১ হাজার ৩৯৪টি পলিসির অভিযোগ আছে। ১ হাজার ২১০ জন গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করছে না সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স। ব্যবসায়ী মো. আবদুর রবের মালিকানাধীন হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৭৮৮টি পলিসির টাকা দিচ্ছে না। বিকল্প ধারা বাংলাদেশের নেতা মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন সানফ্লাওয়ার লাইফের বিরুদ্ধে ১১৫টি অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, পলিসির টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য প্রতিদিনই আইডিআরের কর্মকর্তাদের রুমের সামনে গ্রাহকের লাইন। দীর্ঘদিন কোম্পানির কাছে ধরনা দিয়ে শেষ পর্যন্ত আসছে আইডিআরের কাছে। হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অফিসে কেউ গেলে ভিড় দেখে মনে হবে এখানে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য বিতরণ হচ্ছে। কর্মকর্তাদের সামনে গ্রাহকরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে।
সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান রুবিনা হামিদ। বর্তমানে তিনি বীমা মালিকদের সংগঠন বিআইএর প্রথম সহসভাপতি। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গ্রুপ বীমা রয়েছে তার কোম্পানিতে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান নামেই টিকে আছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
এরপর প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু খুদে বার্তার মাধ্যমে লিখে জানানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম শরিফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দাবি পরিশোধের বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া। তবে যে দাবিগুলো পরিশোধ হয়নি, তার মধ্যে কোম্পানিরও সমস্যা আছে আবার গ্রাহকেরও সমস্যা আছে। তিনি বলেন, দাবি পরিশোধ নিয়ে আইডিআরের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। তাদেকে বিস্তারিত বলে দিয়েছি। আশা করছি, এগুলো পরিশোধ হয়ে যাবে।
নিয়ম অনুসারে একজন গ্রাহক জীবন বীমায় কিস্তিতে টাকা জমা রাখে। এই কিস্তি মাসিক, তিন মাস অথবা ছয় মাসের হতে পারে। এসব পলিসির মেয়াদ ৫ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত। জীবনের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য এই দীর্ঘ সময় তারা স্বল্প আয় থেকে একটু একটু করে টাকা জমা রাখে।
বীমা আইন অনুসারে পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিশ্রুত টাকা দিতে হয়। আর ৯০ দিনের বেশি হলে বাকি দিনগুলোর সুদসহ টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু কোম্পানিগুলো টাকা পরিশোধ না করে গ্রাহককে বছরের পর বছর হয়রানি করছে। এরা পলিসির টাকা আত্মসাৎ করেছে। সূত্র বলছে, পুরো বীমা খাতেই বিশৃঙ্খলা রয়েছে। গ্রাহকের জমা টাকা তাদেরকে ফেরত দিতে হবে, এই হিসাব প্রায় কোনো কোম্পানিরই নেই। কোনো আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে টাকা ব্যয় করছে।
জানতে চাইলে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করছে না, এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা বেশি নয়। তবে কয়েকটি কোম্পানি এ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।
তিনি বলেন, এ খাতের আস্থা অর্জনের জন্য সবার আগে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে হবে। আর কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আইডিআরএ যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তার সঙ্গে একমত। তবে আমি আশা করছি, সামগ্রিকভাবে এই শিল্পের স্বার্থে আইডিআরএ সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে।