জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিশেষ নিরীক্ষায় ৩০টি বড়ো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিশাল অঙ্কের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ফাঁকি ধরা পড়েছে। প্রাথমিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের ৭৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে মোবাইল ফোন, ওষুধ, সিরামিক, ব্যাংক, বিমা প্রতিষ্ঠান, দুগ্ধজাত পণ্য, সিমেন্ট, খাদ্য ও পানীয় খাতের প্রতিষ্ঠান। অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে ৫৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ভ্যাট ফাঁকির অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এনবিআরের বৃহত্ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ ভ্যাট) অফিস তাদের আওতাধীন সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কার্যক্রম ও নথিপত্রের ওপর বিশেষায়িত নিরীক্ষা কার্যক্রম চালায়। ঐ নিরীক্ষায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের এসব ফাঁকি ধরা পড়ে। অপেক্ষাকৃত বড়ো অঙ্কের ভ্যাট পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এলটিইউ অফিসের মাধ্যমে রাজস্ব পরিশোধ করে থাকে। এর মধ্যে মোবাইল ফোন কোম্পানিসহ অনেকের বিরুদ্ধেই রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে।
এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ‘ভ্যাট অফিসে দাখিল করা কাগজপত্র, প্রতিষ্ঠানে রক্ষিত নথি, শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ঘোষিত আর্থিক বিবরণী কিংবা ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে জমা দেওয়া বিবরণী বিস্তারিত নিরীক্ষার মাধ্যমে এসব অনিয়ম ও ফাঁকি উদ্ঘাটন হয়েছে। চলতি অর্থবছরও এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ফাঁকির বিষয়টি স্বীকার করে এরই মধ্যে ৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। অন্যদের বিষয়ে এনবিআরের আপিলাত ট্রাইব্যুনাল ও উচ্চ আদালতে আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আশা করছি, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত ঐ অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হবে।’
সূত্র জানায়, কারিগরি, তথ্যপ্রযুক্তিজ্ঞানে অভিজ্ঞ ও আইনগত বিষয়ে পারদর্শী এনবিআরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে ভ্যাট অফিস। বিশেষায়িত নিরীক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের আমদানির তথ্য যাচাই, ব্যাংক হিসাব বিবরণী, ডিলারের সঙ্গে লেনদেনের তথ্য যাচাই, কোন দরে বিক্রি হচ্ছে আর কোন দরে ভ্যাট অফিসকে দেখানো হচ্ছে, কাঁচামাল কোথা থেকে আসে কিংবা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হচ্ছে কি না—এসবের সঙ্গে ভ্যাট অফিসে প্রতি মাসে দাখিল হওয়া রিটার্নের তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে আকস্মিক উপস্থিত হয়ে প্রতিষ্ঠানের কাছে রক্ষিত কাগজপত্র পর্যালোচনা করা হয়। এছাড়া বড়ো কোম্পানির আয়কর ও ভ্যাট ফাঁকি ধরতে সম্প্রতি গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে আকস্মিক অভিযানও পরিচালনা করা হয়।
বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষার পর ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ফাঁকির আলামতও সরিয়ে ফেলছে বলে অডিটের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, বড়ো ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে ভ্যাট প্রদান করছে কি না, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর বাইরে অতীতে ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক হিসাবপত্র দিয়েছে কি না, তাও যাচাই করা হচ্ছে। এতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই অনিয়ম বেরিয়ে আসছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আলামত সরিয়ে ফেলার পর ভিন্ন উপায়ে অনিয়ম বের করা সম্ভব হয়েছে।
সূত্র জানায়, অতীতে এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের ভ্যাট অফিসগুলো কিছু নিয়মমাফিক অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করত। তবে গত তিন বছর থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করাসহ বিশদ অডিট কার্যক্রম শুরু করে। এর ফলে একের পর এক বড়ো অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়ছে। এর আগের অর্থবছর ২০১৭-১৮ সালে ২৯টি প্রতিষ্ঠান অডিট করার মাধ্যমে ১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়।
বর্তমানে এলটিইউ-ভ্যাট বিভাগের অধীনে ১৭০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ১৫৬টি প্রতিষ্ঠান এলটিইউতে অফিসে ভ্যাট প্রদান করে। এ অফিসে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট আদায় হয় তামাকজাত পণ্যের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। গত অর্থবছর সিগারেট খাতের কোম্পানিগুলোর কাছ থেকেই আদায় হয়েছে ২৫ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা।