২০২০ ওয়েব প্রযোজনার বছর

বিনোদন

‘পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুবক’—সেই সত্যি মেনে ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে বিনোদনের বিশ্ব। ইন্টারনেট থাকলে সেই বিনোদনের বিশ্বকে পকেটে পুরে ঘুরতে পারবেন আপনিও। ঘুম থেকে উঠে আপনি যদি ঢুঁ দেন অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে, তাহলেই দেখবেন বিনোদনকে এখন আর আটকে রাখা যাচ্ছে না কাঁটাতারের বেড়ায়। সময়ের দাবি মেনে বাংলাদেশেও ‘হইচই’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘বঙ্গ’, ‘আইফ্লিক্স’ ‘রবি টিভি প্লাস’, ‘সিনেস্পট’, ‘বাংলাফ্লিক্স’ বা ‘জি–ফাইভ’-এর মতো অনলাইনগুলো সিনেমা হল, টিভি, ডিভিডিকে সরিয়ে ক্রমেই দখল করে নিচ্ছে বিনোদনের ক্ষেত্র। ২০২০ সালে বাংলাদেশের স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো কে কীভাবে বিনোদনের পসরা সাজিয়ে ডাকবে দর্শক, তা নিয়েই এই আয়োজন।

থ্রিলারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি 

অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট প্রযোজনার ক্ষেত্রে দ্য গুড কোম্পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম৷ এ বছর এই প্রতিষ্ঠান হইচই, বায়োস্কোপ, জি–ফাইভ ও রবি—এই চারটি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের জন্য কনটেন্ট প্রযোজনা করবে। ইতিমধ্যে তিনটি চলচ্চিত্র আর চারটি ওয়েব সিরিজ প্রযোজনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দ্য গুড কোম্পানির হেড অব প্রজেকশন শায়লা আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দর্শক সবচেয়ে বেশি খোঁজে অ্যাকশন থ্রিলার। সেটি মাথায় রেখে আমরা সব ধরনের সিরিজ ও সিনেমা প্রযোজনা করছি।’

মানের সঙ্গে আপস করবে না হইচই

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের দর্শকদের সামনে যাত্রা শুরু করে হইচই ফেলে দেয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই। গত বছর ঢাকা মেট্রো আর মানিহানি—এই দুটি ওয়েব সিরিজ মুক্তি দিয়েছে হইচই বাংলাদেশ। এই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ অংশের বিজনেস লিড সাকিব আর খান জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের দুটি প্রযোজনাই প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সাড়া ফেলেছে, জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।’ ২০২০ সালের পরিকল্পনা নিয়ে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছে, তখন তিনি এই প্ল্যাটফর্মের নতুন কনটেন্টের কাজে কলকাতায়। সেখান থেকেই জানালেন, নতুন বছর নিয়ে তাঁদের ভাবনার কথা। ইতিমধ্যে তিন মাসের অফলাইন সাবস্ক্রিবশন শুরু করেছে হইচই। গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ারের মোবাইল ফোন কিনলেও পাওয়া যাচ্ছে বিনা মূল্যে সাবক্রিবশন৷ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দর্শক কী ধরনের কনটেন্ট দেখতে চায়? সাকিব আর খান জানালেন এই প্রশ্নের ভিত্তিতে তাঁদের দর্শক জরিপের ফলাফল, ‘খুব ধীর কনটেন্ট দর্শক এখানে দেখতে চায় না। থ্রিলার দর্শকের প্রথম পছন্দ। আর ইউটিউবে যা আছে, আমরাও যদি সেই জাতীয় কনটেন্ট-ই রাখি, তাহলে দর্শক কেন দেখবে? দিন শেষে তারা টাকা দিয়ে দেখছে, তাই মানের সঙ্গে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। আর মানসম্মত কনটেন্ট দর্শক দেখে। টাকা দিয়েই দেখে।’ ২০২০ সালে হইচই নিয়ে আসছে নতুন ওয়েব সিরিজ। এর মধ্যে একটির শুটিং চলছে। চলচ্চিত্র নিয়েও ভাবছে হইচই। দুই ঈদ ঘিরেও রয়েছে আলাদা পরিকল্পনা৷ এ ছাড়া চলতি বছর হইচইয়ের জন্য কনটেন্ট বানাচ্ছেন মনপুরা ও স্বপ্নজাল খ্যাত নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম। ৩০ মিনিটের সেই গল্পের নাম থ্রি কিসেস। হইচই পাঁচফোড়ন নামে একটি ওয়েব সিরিজ বানায়। যেখানে পাঁচজন নির্মাতার পাঁচটি প্রযোজনা থাকে। ২০২০ সালের ভালোবাসা দিবসে মুক্তি পাবে এই পাঁচফোড়ন। এখানে ভারতের তিন নির্মাতার সঙ্গে থাকবে বাংলাদেশের গিয়াস উদ্দিন সেলিম ও নুরুল আলম আতিকের দুটি ওয়েব কনটেন্ট৷ সব মিলিয়ে চলতি বছর ১২টি নতুন কনটেন্টের পরিকল্পনা আছে তাদের।

বাংলা সিনেমার ‘চূড়ান্ত গন্তব্য’ হতে চায় বায়োস্কোপ 

 ২০২০ সালে বায়োস্কোপ নিয়ে আসবে ওয়েব সিরিজ উৎসবের রাত। সমরেশ মজুমদারের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ওয়েব সিরিজে দেখা যাবে আবুল হায়াত, দিলারা জামানের মতো গুণী অভিনয়শিল্পীদের। যদিও বায়োস্কোপে ভারতীয় বাংলা কনটেন্ট আর টক শো দেখার প্রবণতা বেশি, তারপরও মোট ভিউয়ের শতকরা ২০ ভাগ এসেছে বায়োস্কোপ অরিজিনাল থেকে। ২০২০ সালে এই মাত্রা আরও বাড়বে বলে আশাবাদী বায়োস্কোপের কনটেন্ট অ্যান্ড মার্কেটিং লিড জাকী মো. আদনান। তিনি জানান, ২০১৯ সালে গন কেইস, দ্বিতীয় কৈশোর, বিউটি অ্যান্ড দ্য বুলেট, নীল দরজা ও গার্ডেন গেইম নামের প্রযোজনাগুলো আলোচিত হয়েছে। চলতি বছরে এই প্ল্যাটফর্ম বেশ কিছু নতুন কনটেন্ট নিয়ে আসবে। পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্রকেও প্রাধান্য দিচ্ছে বায়োস্কোপ। তাদের অনুধাবন, দর্শক বাংলা সিনেমা দেখতে চায়। তাই নতুন, পুরোনো, মৌলিক—সব ধরনের বাংলা সিনেমার আধার হতে চায় বায়োস্কোপ। যাতে দিন শেষে দর্শক বাংলা সিনেমার কাছে ফিরতে বায়োস্কোপে আসে। দর্শকদের প্রতি তাদের একটাই অনুরোধ, দর্শক যেন প্রতিদিন দেশি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম স্ট্রিম করে।

২০২০ সালেই মুক্তি পেতে পারে পরীমনি অভিনীত ওয়েব সিরিজ পাফ ড্যাডি
২০২০ সালেই মুক্তি পেতে পারে পরীমনি অভিনীত ওয়েব সিরিজ পাফ ড্যাডি

দর্শককে টাকা দিয়ে দেখতে হবে 

মাত্র ছয় মাস হলো যাত্রা শুরু করেছে বঙ্গ। এর মধ্যেই এদের ২২ শে এপ্রিল, আমাদের সমাজবিজ্ঞান, এই শহরে, মিস শিউলি, জলছবিসহ আরও বেশ কয়েকটি নাটক আলোচনায় আসে। শিকারি, নবাব, লিডার, অগ্নি ২, বসগিরি, ঢাকা অ্যাটাক, টেলিভিশন, মিস্টার বাংলাদেশ, মনপুরা, মোল্লা বাড়ির বউসহ অসংখ্য চলচ্চিত্র আছে এই অ্যাপে৷ তবে বঙ্গর পরিচালক মুশফিকুর রহমান মনে করেন, বাংলাদেশের দর্শক এখনো টাকা খরচ করে কনটেন্ট দেখার জন্য প্রস্তুত নন। ২০২০ সালে প্লাটিনাম ফরমেটে বঙ্গকে নতুন করে উদ্বোধন করা হবে৷ দর্শকেরা যদি বঙ্গ থেকে ফ্রি কনটেন্ট দেখতে চান, সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনসহ দেখতে হবে। আর যদি অর্থের বিনিময়ে ডেটা প্যাক কিনে দেখেন, সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন ছাড়াই দেখতে পারবেন নাটক–সিনেমা। ২০২০ সালে ১২ মাসে ১২টি অরিজিনাল ওয়েব সিরিজ মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা আছে বঙ্গর। ইতিমধ্যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত নো ল্যান্ডস ম্যান ছবির প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই প্ল্যাটফর্ম৷ তা ছাড়া, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, নুরুল আলম আতিকসহ দেশের প্রথম সারির নির্মাতাদের সঙ্গেও আলাপ চলছে এই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের। মুশফিকুর রহমানের ভাষায়, ‘আমরা কনটেন্ট নির্মাণ ও বিপণনকে একটা পেশাদার, মানসম্মত ইকো সিস্টেমের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। যেখানে শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক ও কলাকুশলীরা তাঁদের মেধা আর শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন পাবেন। কেবল দর্শকদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা টাকা দিয়ে ভালো কনটেন্ট দেখুন। তাহলেই পুরো সিস্টেমটা দাঁড়িয়ে যাবে।’

নির্মাতাদের ভাবনা 

ঢাকা মেট্রোখ্যাত নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী শুরু থেকেই বলে আসছেন, নির্মাতাদের জন্য ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চমৎকার জায়গা। নতুন বছরের জন্য তাঁর বেশ কিছু পরিকল্পনাও রয়েছে। তবে দেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো এখনো প্রস্তুত নয় বলে মন্তব্য করেছেন এই নির্মাতা। অন্যদিকে ২০২০ সালে গোলাম কিবরিয়া ফারুকী ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে দাঁড়ানোর সময় দিতে হবে। এক দিনে বা এক বছরে সেটা হবে না। আমাদের সবাইকে সবার কাজটা ঠিকভাবে করতে হবে। মানের সঙ্গে আপসের সুযোগ নেই। কারণ, দিন শেষে আমাদের নিজেদের প্ল্যাটফর্মকে পাল্লা দিতে হবে নেটফ্লিক্সের সঙ্গে।’ নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বলও অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে দেখছেন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। পরিমনি অভিনীত তাঁর পরিচালনা নির্মিত ওয়েব সিরিজ পাফ ড্যাডির নয়টি এপিসোডের কাজ শেষ। এ বছর আসতে পারে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ওয়েব সিরিজও।

একটি সিরিজ, একটি চলচ্চিত্র নিয়ে আসছে জি–ফাইভ

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের বাজারকে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের জন্য সম্ভাবনাময় বলে মনে করছেন ওটিটি সাইট জি–ফাইভের চিফ বিজনেস অফিসার অর্চনা আনন্দ। গত মঙ্গলবার এই প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য আন্তর্জাতিকের প্রযোজনার পাশাপাশি দেশি প্রযোজনা তৈরির তথ্য প্রকাশ করল। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যম জানাল, চলতি বছর তারা নিয়ে আসছে একটি ওয়েব সিরিজ, একটি চলচ্চিত্র ও একটি ট্যালেন্ট হান্ট শো। এর মধ্যে চলচ্চিত্রটি এপ্রিল ও ওয়েব সিরিজটি মে মাসের মধ্যে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান অর্চনা। জিফাইভের ওয়েব সিরিজটির নাম কন্ট্রাক্ট। এটি পরিচালনা করছেন কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও তানিম নূর। এতে অভিনয় করছেন আরিফিন শুভ, তাহসান খান, ইরেশ যাকের, তারিক আনাম খান। অন্যদিকে এই মাধ্যমের চলচ্চিত্র যদি… কিন্তু… তবুও পরিচালনা করতে যাচ্ছেন শিহাব শাহীন। এতে অভিনয় করবেন অপূর্ব, জাকিয়া বারী মম, সারিকা সাবা। অর্চনা আনন্দ মনে করেন, বাংলাদেশের বাজারের জন্য ২০২০ সাল হতে যাচ্ছে অর্থবহ একটি বছর। এদিকে এই দুটি প্রযোজনার সঙ্গেই যুক্ত আছে দ্য গুড কোম্পানি। এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ক্রিয়েটিভ হেড সরদার সানিয়াত হোসেন বলেন, নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্রের যেমন একটা স্বর্ণ সময় ছিল, তেমনই ২০২০ হতে যাচ্ছে মৌলিক কনটেন্ট প্রযোজনার জন্য স্বর্ণ সময়ের শুরু।সূত্রে: প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.