শাহীন সুলতানা, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি :
কমরেড মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন
একজন কৃষক নেতা। গরীব দুঃখী ও মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। মজুরি লড়াই এর সাহসী সৈনিক।
তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার সালুয়া ইউনিয়নে এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে ১৯৫৫ সালে জন্ম গ্রহন করেন।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানের উত্তাল সময়ে ৯ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে তিনি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে মাত্র ১৬ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে এলাকার বাম নেতৃবৃন্দের সাথে ভারত চলে যান। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
তার বয়স এবং দৈহিক গড়নে ছোট-খাটো থাকার কারণে তাকে প্রথমে ট্রেনিংএ নিতে চাননি। অনেক কান্নাকাটি করলে অবশেষে তাকে ট্রেনিং এ নেয়া হয়।
ওই সময় তিনি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনজুরুল আহসান খানের সান্নিধ্যে আসেন এবং বেশ কিছুদিন তাঁর সাথেই ছিলেন। সেই থেকে মনজুরুল আহসান খানের সাথে তাঁর একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং আমৃত্যু তা বহাল ছিল। মনজুরুল আহসান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে তিনি কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসেন এবং মার্কসীয় মতবাদে শিক্ষা নেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
যেখানেই অন্যায়, অবিচার, শোষণ- সেখানেই কমরেড হানিফ ছুটে যেতেন। তাঁর নেতৃত্বে স্থানীয় ইজারা আন্দোলন, টেস্ট রিলিফের আন্দোলন, পাটসহ কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্যের আন্দোলন, বাজরা-ডুমরাকান্দা শহীদ মিনার রক্ষা আন্দোলন, মাটি কাটা শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের সুফল হিসাবে স্থানীয়ভাবে ‘সু-বিচারের মোড়’ প্রতিষ্ঠা হয়।
তিনি একজন ন্যায় বিচারক, নিঃস্বার্থ সমাজসেবক, দক্ষ পল্লী চিকিৎসক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হলে ছয় মাস বিনা বিচারে কারাবাস করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তখন কিশোরগঞ্জ জেলে কমিউনিস্ট পার্টির ১৭ জনসহ প্রায় ৭০ জন কারাবন্দি ছিলেন। কারা অভ্যন্তরে ১৯৮৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করেন। তখন কমরেড হানিফ বাঁশ দিয়ে খুব সুন্দর করে শহীদ মিনার নির্মাণ করেছিলেন। এতে অনেকেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং আলোচনা সভা করেন।
কারারুদ্ধ অবস্থায় তিনি কুলিয়ারচর উপজেলার সালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তাঁর কোনো টাকা খরচ করতে হয়নি, উল্টো গরীব মানুষেরা তাদের হাঁস, মুরগি, ডিম বিক্রি করে তার নির্বাচনী তহবিল গড়ে তুলেছিলেন।
তিনি বিভিন্ন আন্দোলনে বহুবার গ্রেফতার হয়ে থানায় আটক ছিলেন এবং হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের মেদেনীপুরে সারা ভারত কৃষাণ সভার ২৭তম সম্মেলনে বাংলাদেশ কৃষক সমিতির প্রতিনিধিত্ব করেন।
তিনি বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কিশোরগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ছিলেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আপোষহীণ কমরেড হানিফ মার্কসীয় তত্ত্বকে নিজের জীবনের সাথে একাকার করে নিয়েছিলেন। উপজেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় কমরেড হানিফ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। স্বপ্ন দেখে গেছেন শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজের।
তিনি সুস্থ্যধারার সংস্কৃতি নির্মাণে আজীবন কাজ করে গেছেন। তিনি নাটক রচনা ও অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর স্বরচিত নাটক আলোরপথে, ভিলেজ পলিটিক্স, বাঙালির ইতিহাস বাঙালির জীবন সংগ্রাম, হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ হয়েছে। কারাবরণকালে তিনি কাঠ খুদাই করে লেনিনের ছবি তৈরি করে কারুশিল্পী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। স্বাধীনতার পর তিনি কিছুদিন ডুমরাকান্দা এমাদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। রাজনৈতিক প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন।
চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে তিনি মদ, জুয়া, চুরি, ডাকাতি বন্ধে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ডাকাতদের অস্ত্রজমাদানসহ তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এক সাধারণ কৃষক পরিবারের মা-বাবার একমাত্র পুত্র হয়েও জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামে।
তিনি ২০১০ এর ১ সেপ্টেম্বর ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। এলাকাবাসী এখনো তাঁর জন্য দু’চোঁখের জল ফেলে কাদে।