প্রধানমন্ত্রীর সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। নায়িকার গাড়িচালক ছিলেন, দৈনিক হাজিরায় কাজ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী মো. জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। নিজে জীবিকা নির্বাহের জন্য চিত্রনায়িকার গাড়ি চালিয়েছেন। জাতীয় সংসদে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেছেন। অবশ্য এখন তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
জাহাঙ্গীরের গ্রামের লোকজন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, তিনি অর্থবিত্তের মালিক হতে শুরু করেন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় ব্যবহার করে তিনি নিয়োগ–বাণিজ্য, বদলিসহ নানা তদবির করতেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাহাঙ্গীর নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করে বেড়াচ্ছেন। তবে তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
জাহাঙ্গীর গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নও চেয়েছিলেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন, তাঁর নিজের নামে প্রায় ২১ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে রয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদ।
জাহাঙ্গীর আলম, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন। জাহাঙ্গীর মুঠোফোনে গতকাল সোমবার নিজেকে রাজনীতির শিকার দাবি করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চৌদ্দগুষ্টির সম্পদ বিক্রি করলেও ৪০০ কোটি টাকা হবে না। আমার ট্যাক্স ফাইল (কর নথি) সরকারি দপ্তরে জমা দেওয়া আছে। এর বাইরে কোনো সম্পদ নেই।’ তিনি আরও বলেন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হেয় করার জন্য একটি চক্র মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। তিনি শিগগিরই দেশে ফিরবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রোববার চীন সফর নিয়ে তাঁর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক...কী করে বানাল এত টাকা? জানতে পেরেছি, পরেই ব্যবস্থা নিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রীর কারও নাম উল্লেখ করেননি।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন, তাঁর নিজের নামে প্রায় ২১ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে রয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদ।
এদিকে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গত রোববার জাহাঙ্গীর, তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহার এবং তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের হিসাব খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।
জাহাঙ্গীরের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার খিলপাড়া ইউনিয়নের নাহারখিল গ্রামে। তাঁর বাবার নাম রহমত উল্যাহ। গতকাল সোমবার নাহারখিল গ্রামে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের বাবা খিলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের কেরানি ছিলেন। এ কারণে তিনি ‘রহমত কেরানি’ নামে পরিচিত। তাঁর পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। ভাইদের মধ্যে জাহাঙ্গীর দ্বিতীয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই আলমগীর হোসেন দুই মেয়াদ ধরে খিলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তাঁর বড় ভাই মীর হোসেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। এক ভাইকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা এবং আরেক ভাইকে আওয়ামী লীগের পদ পাইয়ে দিতে তিনি নিজের প্রভাব ব্যবহার করেছেন।
জাহাঙ্গীর ঢাকায় যাওয়ার পর এক চিত্রনায়িকার গাড়ি চালানো, সংসদ ভবনে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করা, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) বাসায় চাকরি করার বিষয়টি জানিয়ে তাঁর ভাই মীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীর জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। এখন ভালো আছেন, সেটা কারও কারও সহ্য হচ্ছে না।
গ্রামের মানুষেরা জানান, জাহাঙ্গীর নিজের প্রভাব ব্যবহার করে তাঁর এলাকায় রাস্তাঘাট পাকা করেছেন। নিজে দানখয়রাত করতেন। গ্রামের দুটি রাস্তার নামকরণ করিয়েছেন তাঁর বাবার নামে। গ্রামবাসীর ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে জাহাঙ্গীর দামি গাড়িতে গ্রামে যেতেন। তাঁর পেছনে মোটরসাইকেলে থাকতেন এক দল তরুণ। তিনি লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতেন। চাটখিল ও সোনাইমুড়ী উপজেলার স্কুল-মাদ্রাসার ভবন, সড়ক পাকাকরণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতেন জাহাঙ্গীর।
হলফনামায় জাহাঙ্গীর নিজের শিক্ষাগতযোগ্যতা বিএসএস (সামাজিক বিজ্ঞানে স্নাতক) বলে উল্লেখ করেন। তবে গ্রামবাসীর দাবি, জাহাঙ্গীর মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি।
জাহাঙ্গীর কী পদে ছিলেন, তা জানা যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি চিঠির সূত্রে। ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বরের ওই চিঠিতে জাহাঙ্গীর, তাঁর স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান এবং তাঁর মাকে সার্ক স্টিকার দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
এক ভাইকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা এবং আরেক ভাইকে আওয়ামী লীগের পদ পাইয়ে দিতে তিনি নিজের প্রভাব ব্যবহার করেছেন।
জাহাঙ্গীরের হলফনামায় কৃষি খাত, ভবন ভাড়া, ব্যবসা, ব্যাংকের সুদ, সঞ্চয়পত্র ও চাকরি থেকে বছরে ৪১ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। এর মধ্যে চাকরি থেকে আয় বছরে ৬ লাখ টাকা। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে তিনি ব্যাংকে ২৫ লাখ টাকা, ১ কোটি ৩১ লাখ টাকা স্থায়ী আমানত, ব্যবসার অংশীদারত্ব বাবদ ৫৮ লাখ টাকা, ৭৫ ভরি সোনা, অংশীদারি ব্যবসার মূলধন বাবদ প্রায় সোয়া ৬ কোটি টাকা, একটি পিস্তল এবং আসবাব দেখিয়েছেন। স্ত্রীকে নিজের টাকা থেকে ঋণ দেওয়া বাবদ দেখিয়েছেন প্রায় ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ আছে ৩ কোটি ৮ লাখ টাকার বেশি মূল্যের। এর মধ্যে নগদ (ব্যাংকসহ) আছে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার বেশি।
জাহাঙ্গীরের নিজের নামে সাড়ে চার একরের বেশি কৃষিজমি, ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকার অকৃষিজমি, মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান, মিরপুরে ৭ তলা ভবন, গ্রামের বাড়িতে ১ তলা ভবন ও মিরপুরে দুটি ফ্ল্যাট দেখিয়েছেন। এর মধ্যে মিরপুরে দুটি ফ্ল্যাটের দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে তিনি স্থাবর সম্পদের মূল্য দেখিয়েছেন ৮ কোটি ১১ লাখ টাকা।
স্ত্রীর নামে ৮ তলা ভবন, ঢাকার ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট এবং কৃষি-অকৃষিজমি রয়েছে। সব মিলিয়ে তাঁর স্থাবর সম্পদের মূল্য দেখানো হয়েছে ৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
জাহাঙ্গীর পরিবারের একটি আটতলা বাড়ি রয়েছে নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর হরিনারায়ণপুর এলাকায়। বাড়িটির ১৯টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৮টি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তিনতলার একটি ফ্ল্যাট ব্যবহার করে জাহাঙ্গীরের পরিবার। গতকাল সকালে শহরের ওই বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায় তত্ত্বাবধায়ক আমিনুল ইসলামকে। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর প্রায় আড়াই মাস আগে সর্বশেষ ওই বাড়িতে যান।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর পরিচিত মুখ। তাঁর আচরণে বেশির ভাগ ছিলেন বিরক্ত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীরের কাজই ছিল বড় বড় তদবির ও নিয়োগ–বাণিজ্য। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি টের পেয়েই তাঁকে সরিয়ে দেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করলেই তাঁর আয়বহির্ভূত সম্পদ বেরিয়ে আসবে।
জাহাঙ্গীরের নিজের নামে সাড়ে চার একরের বেশি কৃষিজমি, ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকার অকৃষিজমি, মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান, মিরপুরে ৭ তলা ভবন, গ্রামের বাড়িতে ১ তলা ভবন ও মিরপুরে দুটি ফ্ল্যাট দেখিয়েছেন।
সূত্রঃ প্রথম আলো