ঢাকা: রাজধানীর সদরঘাটে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। আর কুলিদের (ঘাট শ্রমিক) হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন অসহায় যাত্রীরা। অথচ যাত্রীসেবার জন্য সরকারি পয়সায় দৈনিক ভাতা দিয়ে কুলিদের ‘পুষছে’ ঢাকা নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ।
দুপুর পৌনে তিনটা, সদরঘাট টার্মিনাল। চাঁদপুর থেকে এমভি রাসেল-৩ লঞ্চে ঢাকায় এসেছেন ইমরান হোসেন (ছদ্মনাম)। চটের ব্যাগ ও বস্তায় কিছু আম, বেগুন, কচুর ডগা ও ডাটা শাক সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তিনি।
টার্মিনালে নামার আগেই লঞ্চের ডেকে হলুদ জামা পরা একদল কুলি ইমরান ও তার সঙ্গে আসা সবাইকে ঘিরে ধরেন। তাদের সঙ্গে থাকা চটের ব্যাগ, বস্তার জন্য ‘ঘাটের টাকা’ দিতে হবে বলে ১৫’শ টাকা দাবি করেন তারা।
মালামাল নিজে বহন করলেও টাকা দিতে হবে। ইমরান ২০০ টাকা দিতে চাওয়ায় ব্যাগ নিয়ে টানা-হেঁচড়া ও হুমকি-ধমকিও দেয় কুলিরা।
একই লঞ্চে থাকা বাংলানিউজের ক্যামেরায় গত শনিবার (২৫ মে) দুপুরের দিকে এ ঘটনা ধরা পড়ে। প্রথমে গোপনে ভিডিও করলেও যাত্রী বেশে পাহারায় থাকা কুলিরা বিষয়টা টের পেয়ে যান। পরে প্রকাশ্যে ভিডিও করার সময় দফায় দফায় বাধা দেন তারা।
সংঘবদ্ধ এই চক্র এভাবে ব্যাগ, বস্তা, লাগেজ সঙ্গে থাকা লঞ্চ যাত্রীদের টার্গেট করে এবং চাঁদাবাজি করে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
ঢাকা নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘ঘাটের টাকা’র নাম করে চাঁদা তোলা তো দূরের কথা যাত্রীদের অনুমতি ছাড়া তাদের মালামালে হাত দেওয়ারও সুযোগ নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু চাঁদাবাজি আর যাত্রী হয়রানিই নয় সদরঘাট টার্মিনালে চলছে নানা অনিয়ম। যার পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদরঘাট সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, কুলিদের মাধ্যমে অবৈধভাবে সংগ্রহ করা টাকার অংকটা অনেক বড় হওয়ায় এর পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের বেশ কিছু নেতার পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারাও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত বলে জানায় সূত্রটি।
অপর আরেক সূত্র জানায়, যাত্রীদের নিরাপত্তা ও ঢাকা নদীবন্দর সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা, নিরাপত্তা কর্মীরা অর্থনৈতিক সুবিধা, কখনো কখনো সিন্ডিকেটের চাপের কারণেও কুলিদের চাঁদাবাজি ও অনিয়মের সুযোগ করে দেন।
সদরঘাট টার্মিনালে নিউ ভিশন ইকোসিটি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০৪ জন কুলি বা ঘাট শ্রমিক কাজ করেন বিআইডব্লিউটিএ-এর জন্য। নিউ ভিশন ইকোসিটি লিমিটেডের পরিচালক দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ আওয়ামী যুবলীগের নেতা শিপু আহমেদ।
ঢাকা নদীবন্দর কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, নিউ ভিশন ইকোসিটি লিমিটেডের অধীনে নেওয়া ঘাট শ্রমিকদের দৈনিক ৩৬৫ টাকা ভাতা হিসেবে দেওয়া হয়।
সদরঘাট টার্মিনালে সরাসরি বিআইডব্লিউটিএ-এর অধীনেও আরও ৭০/৮০ জন ঘাট শ্রমিক (পোর্টার নামে পরিচিত) কাজ করছেন।
হয়রানির শিকার ইমরান হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, কচু, আম, বেগুন ও কিছু শাকসবজি ঢাকায় পরিবারের সদস্যদের জন্য নিয়ে এসেছি। কুলিরা ১৫শ’ টাকা দাবি করে। ২০০ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হয়েছি। তারপরও তারা বলছে, তাদের কথামতো টাকা না দিলে ব্যাগ নিয়ে যেতে পারবো না। তারা নাকি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করবে। এর আগেও কুলিদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানান ইমরান।
লঞ্চে ঢাকা-চাঁদপুর রুটের নিয়মিত যাত্রী রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, সদরঘাট টার্মিনালে চাঁদাবাজি ও যাত্রী হয়রানির এ দৃশ্য নিয়মিত। এক প্রশ্নের জবাবে রায়হানের বন্ধু জুয়েল রানা বলেন, অভিযোগ দিয়ে কি হবে? ঝামেলার ভয়ে অনেকে নীরবে টাকা দিয়ে চলে যান।
তিনি বলেন, কুলিরা বলে বন্দর কর্মকর্তারা তাদেরই লোক। ঘাট কর্তৃপক্ষ নাকি তাদের টাকা তোলার দায়িত্ব দিয়েছে। সেখানে আমরা কার কাছে অভিযোগ করবো?
জুয়েল আরও বলেন, যখন চাঁদাবাজি হয় তখন আশেপাশে সংশ্লিষ্ট কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি অন্য যাত্রীরা এগিয়ে আসে না, না দেখার ভান করে চলে যায়।
অপর এক যাত্রী শহীদুল ইসলাম বলেন, চাঁদার জন্য কুলিরা আমাদের সঙ্গে মাস্তানের মতো আচরণ করে। অথচ বন্দর কর্তৃপক্ষ সরকারি পয়সায় দৈনিক ভাতা দিয়ে এসব কুলি পুষছে। এরা পোষা মাস্তান! এটা দুঃখজনক।
যাত্রী হয়রানি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে টার্মিনালের দায়িত্বরত বন্দর ও পরিবহন বিভাগের উপ-পরিচালক একেএম কায়সারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিষয়টা নিয়ে প্রচণ্ড রকম বিব্রতকর অবস্থায় আছি, এ বিষয়ে টেককেয়ারও করছি।’
ক্রমাগত যাত্রী হয়রানি কমে এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বলবো না, নির্মূল হয়েছে; তবে কমেছে। নির্মূলের চেষ্টা করছি।’
এক্ষেত্রে যাত্রী সচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করে কায়সারুল ইসলাম বলেন, সিসি ক্যামেরা দিয়ে বন্দরের কার্যক্রম মনিটর করা হয়।
সিসি ক্যামেরায় মনিটর করা হলে অভিযোগ ছাড়াও কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয় না কেন? প্রশ্নের জবাবে কায়সারুল বলেন, ‘হ্যাঁ, প্রচুর ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’
চাঁদাবাজি-হয়রানির বিরুদ্ধে প্রচুর ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কেন এটি বন্ধ হচ্ছে না? অপর প্রশ্নের জবাবে কায়সারুল ইসলাম বলেন, ‘কারণটা হচ্ছে, সদরঘাট হচ্ছে একটা অন্যরকম এলাকা...।’
এক প্রশ্নের জবাবে বিআইডব্লিউটিএ-এর আরেক উপ-পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, ‘সিসি ক্যামেরা মাঝে মধ্যে বিকল থাকে।’
তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে একটু ঝামেলায় আছি। অনেক সময় তারা কাপড়-চোপড় দিয়ে ঢেকে রাখে বা সিসি ক্যামেরার মুখটা অন্যদিকে ঘুরায় রাখে।’
নিউ ভিশন ইকোসিটি লিমিটেডের পরিচালক দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ আওয়ামী যুবলীগ নেতা শিপু আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘সদরঘাটে আগে যে হয়রানি ছিল এখন তার ৯০ শতাংশ কমে গেছে। টুকটাক হতে পারে। এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো, এটা জোর গলায় বলতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, আপ্রাণ চেষ্টা করি। কোনো অভিযোগ পাওয়া মাত্রই কঠোর ব্যবস্থা নিই।’
তথ্য সংগ্রহে বাংলা নিউজ।