৮৬ কোটি টাকার লোভ কাল হলো ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার

রাজনীতি

৮৬ কোটি টাকার লোভই কাল হলো ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নির্বিঘ্নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঈদুল আজহার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ টেন্ডার কমিটির কাছ থেকে দুই কোটি টাকা নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে পুরো প্রকল্প থেকে ছয় ভাগ চাঁদা দাবি করেন শোভন-রাব্বানী।

 

৮ আগস্ট রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে তার বাসভবনে দেখা করে এই চাঁদা চান দুই নেতা। উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছে—এমন কোম্পানির কাছ থেকে ভিসিকে টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন তারা। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর তাতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে দুই নেতা রূঢ় আচরণ করেন। পরে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন ভিসি। এতে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা।

গত ৭ সেপ্টেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের যৌথসভায় ছাত্রলীগের দুই নেতার ধারাবাহিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কমিটি ভেঙে দেওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এখনো প্রধানমন্ত্রী তার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। আজ শনিবার সবার নজর গণভবনের দিকে। সন্ধ্যা ৭টায় আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে অন্যান্য এজেন্ডার পাশাপাশি শোভন-রাব্বানীর ভাগ্য নির্ধারণ হবে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাসময়ে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

শোভন-রাব্বানী এখন ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড চাপের মুখে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পর তাদের পাশে এখন আর কেউই নেই। সবাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন। ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্পাদক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাও শোভন-রাব্বানীকে পাশ কাটিয়ে চলছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ৯ নেতার নেতৃত্বে গঠিত সিন্ডিকেটের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের কারণে ঐ সিন্ডিকেটের সদস্যরাও শোভন-রাব্বানী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের বলয়ের বিকল্প প্রার্থী খোঁজা শুরু করেছেন। এ কারণে তিন দিনেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ চাওয়া সংবলিত রাব্বানীর চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছায়নি।

গত বুধবার রাতে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছেন। যা প্রধানমন্ত্রীকে পৌঁছে দিতে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমানের হাতে দিয়েছিলেন রাব্বানী। চিঠিতে তিনি নিজেদের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, ‘আপনি মুখ ফিরিয়ে নিলে যাবার কোনো জায়গা নেই।’ চিঠিতে শেখ হাসিনাকে ‘মমতাময়ী নেত্রী’ সম্বোধন করে কয়েকটি প্রোগ্রামে দেরিতে যাওয়ার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

গোলাম রাব্বানী গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, চিঠিটি নেত্রীর কাছে পৌঁছানোর তথ্য এখনো পাইনি। পরিকল্পিতভাবে নেত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে, কান ভারী করা হয়েছে। আমরা পূর্বের সিন্ডিকেটের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার। তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ চাই। প্রসঙ্গত, ছাত্রলীগ কয়েক যুগ ধরে, সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। একটি সিন্ডিকেট-যারা বহু বছর দাপিয়ে বেড়িয়েছে—সর্বশেষ সম্মেলনের পর কমিটি গঠনের মাধ্যমে ঐ সিন্ডিকেট একেবারেই নিষ্ক্রিয়। বর্তমান কমিটিতে পূর্বের সিন্ডিকেটের অনুসারী কাউকে রাখা হয়নি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নয় নেতার নেতৃত্বে গঠিত অপর সিন্ডিকেটের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এখন ছাত্রলীগ। তবে হঠাত্ করে দলের হাইকমান্ড ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে এত ক্ষিপ্ত হবে এটা ধারণাতেও ছিল না বর্তমান সিন্ডিকেটের সদস্যদের। এর আগে নানা সময়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পার পেলেও এবার আর শেষ রক্ষা হচ্ছে না—এটা ধরেই নিয়েছে সিন্ডিকেট।

জানা গেছে, রাব্বানীর চিঠিটি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে পাঠানোর কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতা দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে দেখা করে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি। তাই এখন আর কোনো চিঠি নিয়ে দেখা করতে চান না তারা।

গত বছরের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন শেষ হয়। এরপর ৩১ জুলাই রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি এবং গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। শুরু থেকেই দুই নেতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দরজা সবসময় খোলা ছিল। প্রধানমন্ত্রী কমিটি দেওয়ায় শোভন-রাব্বানীর প্রতি আলাদা নজর ছিল আওয়ামী লীগের সব মহলের। তারা ছাত্রলীগকে শেখ হাসিনার প্রত্যাশা অনুযায়ী ‘নতুন ধারায়’ ফিরিয়ে আনবেন এমন আশা ছিল। কিন্তু হলো উলটো। এমন কোনো অভিযোগ নেই—যা ছাত্রলীগের দুই নেতার বিরুদ্ধে আসেনি। বিশেষ করে মাদকের সম্পৃক্ততার বিষয়টি একেবারেই মেনে নিতে পারছেন না আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এখনো পর্যন্ত ইতিবাচক কোনো ইঙ্গিত পায়নি শোভন-রাব্বানী। ছাত্রলীগের বিষয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতা—যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে কয়েক দফা সাক্ষাত্ করেছেন তারা। সবারই কথা একটাই ‘বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে দেখছেন, এখানে কারো কিছু করার নেই। আজ গণভবনে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষায় আছেন তারা।’

ইত্তেফাক/এসআর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.