প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দ্বিতীয় মেঘনা সেতু এবং দ্বিতীয় গোমতী সেতু উদ্বোধন করেছেন। আজ ১১ ,৩০ মিনিট দিকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতু দু‘টি উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠান উপলক্ষে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এক ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়।সেখানে উপস্থিত ছিলেন সড়ক বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খোন্দকার, কুমিল্লার জেলা প্রশাসকসহ জেলার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রালয়ের একটি সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময়ের প্রায় সাত মাস আগে ঢাকা-চট্রগাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায় দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতি সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী গত ১৬ মার্চ এ মহাসড়কের কাঁচপুর দ্বিতীয় সেতুর উদ্বোধন করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত কুমিল্লার মেঘনা-গোমতি এবং মেঘনা ও কাঁচপুর- এ তিনটি সেতুর সমান্তরালে নবনির্মিত দ্বিতীয় সেতুগুলো রাজধানী ঢাকার সাথে বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সড়ক পথের চলাচলে আজ থেকে এক নবদিগন্তের সূচনা হলো।
এ মহাসড়কের ওই তিনটি সেতুকেন্দ্রিক হাজারো যানবাহনের চাপে চিরচেনা যানজটের ভোগান্তি নিরসনে প্রধানমন্ত্রী নির্ধারিত সময়ের প্রায় সাত মাস আগেই এসব সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে স্বস্তির দুয়ার খুলে গেল।
এতে দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন অনেক সহজতর ও সাশ্রয়ী হবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় হবে না।
এদিকে আসন্ন ঈদ-উল ফিতরে মহাসড়কে কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়াই যানবাহন চলাচল করতে পারবে এমন আশায় এ রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহনের চালক, যাত্রী ও নানা শ্রেণিপেশার লোকজন বেশ খুশি,তাদের মাঝে বিরাজ করছে আনন্দ-উচ্ছ্বাস।
আরো পড়ুনঃ পানিতে ভেসে গেল ৩৫ হাজার মণ লবণ
প্রথমবারের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা-গোমতি ও মেঘনা সেতুতে যানবাহনের টোল আদায়ে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ইটিসি) চালু হয়েছে।সংশ্লিষ্টরা জানান, এতে টোল দিতে এখন আর যানবাহনগুলোকে টোল প্লাজায় থামতে হচ্ছে না এবং নগদ অর্থ দেওয়ারও প্রয়োজন হচ্ছে না।
সড়ক বিভাগের কর্মকর্তা,গাড়ির চালক ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ফোরলেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে দৈনিক অন্তত ৩০ হাজার যানবাহন চলাচল করে।এসব যানবাহন এসে আগে একলেনে পুরনো মেঘনা-গোমতী, মেঘনা ও কাঁচপুর সেতুতে উঠতো।এতে যানবাহনের চাপ বেড়ে গিয়ে ধীরগতির কারণে প্রতিটি ধর্মীয়সহ নানা উৎসবে ও সরকারি ছুটির দিনে যানজটে আটকা পড়ে ভোগান্তি পোহাতে হতো যাত্রী ও চালকদের।কিন্তু এবার ঈদের আগে সেতুগুলো খুলে দেওয়ার পর আর কোনো যানজট থাকবে না।এতে মানুষের সময়, খরচ ও ভোগান্তি কমবে এবং ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। যানজটের কারণে এতোদিন যে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হতো তা আর হবে না এবং এতে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান জানান,প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে এই তিনটি সেতু অন্তর্ভূক্ত।মূলত ৫টি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ‘গোমতী,মেঘনা ও কাঁচপুর দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ’ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করা, ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কে ক্রমবর্ধমান যানবাহনের সংকুলান করা, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধন করা, প্রকল্প এলাকায় আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড উন্নত করা এবং সকলের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
এর আগে দ্বিতীয় মেঘনা এবং দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতুর প্রকল্প পরিচালক আবু সালেহ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান জানান, প্রধানমন্ত্রী শনিবার দুটি সেতু উদ্বোধন করবেন। সেতু নির্মাণ করেছে যৌথভাবে জাপানের ওবায়েশী করপোরেশন, সিমিজু করপোরেশন ও জেএফই ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। নির্দিষ্ট সময়ের আগে কাঁচপুর, মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুর সমান্তরালে আরও তিনটি সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এর সাত মাস আগেই নতুন সেতু নির্মাণ ও পুরনো বিদ্যমান সেতুর পুনর্বাসন কাজ শেষ হয়েছে। এতে সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
তিনি আরও জানান, কুমিল্লার দাউদকান্দির দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪১০ মিটার, অর্থাৎ প্রায় দেড় কিলোমিটার। এটি নির্মাণে ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ১৭টি স্প্যানের ওপর নির্মিত এই সেতুর প্রস্থ ১৭.৭৫ মিটার। অপরদিকে ১২টি স্প্যানের ওপর নির্মিত দ্বিতীয় মেঘনা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯৫০ মিটার, অর্থাৎ প্রায় ১ কিলোমিটার। এই সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭৫০ কোটি টাকা। উভয় সেতু চারলেন বিশিষ্ট এবং ১৭.৭৫ মিটার প্রস্থের সেতুতে দেড় মিটার ফুটপাত রাখা হয়েছে। এই দুই সেতুর নির্মাণকাজ তিন বছর পাঁচ মাসে সম্পন্ন করা হয়েছে।
মেঘনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক শওকত আহমেদ মজুমদার জানান, বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো বড় প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ের আগে সম্পন্ন হয়েছে এবং ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য ও বর্তমান সরকারের জন্য একটি মাইফলক ও উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, এটি সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মনিটরিং এবং জাপানের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও তাদের কর্মদক্ষতার কারণে।
মেঘনা-গোমতি সেতুর আবাসিক প্রকৌশলী কবির আহমেদ জানান, জাপানের আধুনিক প্রযুক্তি ও স্টিল ন্যারো বক্সগার্ডারের ওপর এই সেতু নির্মিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশ প্রথম সেতু। এর আগে ভিয়েতনাম ও জাপানে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
মেঘনা-গোমতি সেতুর মেট্রিয়াল অ্যান্ড কোয়ালিটি ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহ আলম জানান, এসপিএসপি শিপ পাইল ফাউন্ডেশন এসিসিটি ডেক্সস্লাব কম্পোজিট স্ট্রাকচারে কোয়ালিটি কন্ট্রোলের মাধ্যমে এই সেতু নির্মাণের কারণে নতুন ও পুরনো দুটি সেতুরই আয়ুষ্কাল হবে ১০০ বছরের বেশি। এছাড়া জাপানের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে সেতুর উপর দিয়ে যানবাহন চলাচলে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি বা শব্দ কিংবা ধাক্কা ক্ষতি হবে না। বিমানবন্দরের রানওয়ের মতো খুব দ্রুতগতিতে সেতুতে যানবাহন চলাচল করবে। এ ছাড়া বর্তমানে দুইটি সেতু পুরাতন ও নতুন মিলিয়ে মোট ছয় লেনের। তাই চারলেনের সড়ক দিয়ে যানবাহন এসে ছয়লেনের সেতুতে চলাচল করতে পারবে, এতে এসব সেতুতে যানজট সৃষ্টি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
কুমিল্লা জেলা বাস ও মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-দপ্তর সম্পাদক ফারুক আহমেদ সুমন জানান, বর্তমানে চার লেনবিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানবাহন এসে মেঘনা ও মেঘনা গোমতি সেতুতে উঠছে এক লেনে। এ কারণে ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের সময়, এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও সেতুগুলোর দুইদিকে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রী ও চালকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।
কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি কামরুল আহসান বাবুল জানান, নবনির্মিত তিনটি সেতু এই মহাসড়কে যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের এবারের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন ও স্বস্তির করবে। এছাড়া চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার ১৯২ কিলোমিটার সড়কপথের যোগাযোগ যুগোপযোগী, দ্রুত ও যানজটমুক্ত করতে সেতু তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, মাত্র ৪ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাতায়াত করা যাবে। এ ছাড়া যানজট লাঘবের পাশাপাশি ভোগান্তি ও দুর্ঘটনার হারও কমবে।
সাবেক রেলপথমন্ত্রী ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুল হক এমপি বলেন, বর্তমান সরকার রেল ও সড়কপথসহ দেশের সকল ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছে। এর বড় প্রমাণ হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেনের কাঁচপুর, মেঘনা ও মেঘনা-গোমতি দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ। সরকার সফলভাবে দ্রুতগতিতে এই মহাসড়কের তিনটি সেতুর কাজ সম্পন্ন করেছে। এজন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রীকে কুমিল্লবাসীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই।
মেঘনা-গোমতি সেতুতে ইটিসি সেবা: দেশে প্রথমবারের মতো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা ও গোমতি সেতুতে গত ৩০ এপ্রিল মেঘনা সেতু টোল প্লাজায় উইন্ডশিল্ড বেইজড ফার্স্ট ট্র্যাক ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ইটিসি) উদ্বোধন করা হয়। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, যানবাহনের টোল আদায়ে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু হয়েছে। এতে টোল দিতে যানবাহনগুলোকে টোল প্লাজায় থামতে হবে না, প্রয়োজন হবে না নগদ অর্থ দেওয়ার। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন হবে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে মেঘনা ও গোমতি সেতুর টোল প্লাজায় একটি করে লেনে এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেনের সংখ্যা বাড়ানো হবে। এজন্য তিনি ইটিসি জনপ্রিয় করতে পরিবহন মালিক, শ্রমিকসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, ইটিসি পদ্ধতিতে গাড়ির সামনের আয়নার উপরিভাগে সংযুক্ত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন বা আরএফআইডি ট্যাগের সঙ্গে টোল গেটের অ্যানটেনার সংকেতের মাধ্যমে টোল আদায় হবে। যানবাহন টোল প্লাজা পার হওয়ার সময় ব্যাংক হিসাব থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত টোল কাটা হবে। টোল আদায়ের পরপরই ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে গ্রাহককে জানিয়ে দেওয়া হবে টোল আদায় এবং ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা কর্তনের সর্বশেষ তথ্য। এ প্রক্রিয়াটি শেষ হতে সর্বোচ্চ ১০ সেকেন্ড সময়ের প্রয়োজন হবে। ইটিসি সেবা গ্রহণের জন্য যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। এ কাজে প্রাথমিক পর্যায়ে সহযোগিতা দিচ্ছে ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড।
উল্লেখ্য, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বাংলাদেশের একটি অন্যতম ব্যস্ত মহাসড়ক, যা ঢাকা থেকে শুরু হয়ে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পর্যন্ত গেছে। আনুমানিক ২৫০ কিলোমিটার মহাসড়কটি বাংলাদেশের দুই বৃহত্তম শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামকে সংযুক্ত করেছে। দুই লেইনের এ মহাসড়কটি বর্তমানে চার লেইনে উন্নীত করা হয়েছে।