আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি এ কথা বহুকাল থেকে প্রচলিত হয়ে আসলেও দিন দিন বাঙালির পাতে কমে যাচ্ছে দেশীয় উন্মুক্ত জলাশয়ের বা নদীর মাছ। ব্যাপক অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণসহ নানা কারণে দেশি মাছের অনেক প্রজাতি আজ বিলুপ্তির পথে এবং বহু প্রজাতি হুমকির মুখে পড়ে বিলুপ্ত প্রায়। দেশের মিঠাপানিতে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩টি হলো ছোট প্রজাতির মাছ, যাহার ৬৪টি প্রজাতি বিলুপ্ত প্রায়।
কুমিল্লা মেঘনা উপজেলার মেঘনা নদী এবং পার্শ্ববর্তী উপজেলা বেষ্টিত বিস্তীর্ণ ছোট-বড় শাখা নদীগুলোতে জেলে নামীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নদীতে বাঁশ ও গাছের ডালপালা দিয়ে স্থাপন করে জাগ বা ঝোপ যাহা কিছুদিন অতিবাহিত হলেই তার চারপাশে জালের বেষ্টনী দিয়ে মাছ নিধনের মহোৎসবে লিপ্ত হয়। নদী সংশ্লিষ্ট উপজেলা সমূহে প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে যত্রতত্র এই জাগ বা ঝোপ দিয়ে মাছ ধরার সাহস পাচ্ছে। ফলে নদীতে তলবাসী মাছ- বোয়াল, আইড়, রিটা, গুজি আইড়, চিতল, গজার, শোল, মহাশোল, ঘনিয়া, কালবাউশ ইত্যাদি প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। এছাড়াও পাবদা, গুলশা, রাজপুঁটি, মেনি, ট্যাংরা, ফলি, শিং, গুতুম, মাগুর, বৈড়ালি, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা, কৈ, বাটা, সরপুঁটি, গনিয়া, মেনি, জাইতপুঁটি, পিয়ালি, বাতাসি, রানী, ঢেলা ও কাকিলাসহ ৩১ প্রজাতির মাছগুলিও বিলুপ্তির পথে। ইতিমধ্যে সংরক্ষণ করা হয়েছে বিলুপ্তপ্রায় ৮৮টি প্রজাতির মাছ।
নদীতে অবৈধভাবে যত্রতত্র জাগ বা ঝোপ দেওয়ার কারণে নদীতে পানি প্রবাহ বিঘ্ন, পলি জমে নদী অগভীর হয়ে যাওয়া, নদীতে মাছের অবাধ চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়া ও মাছের প্রজন ক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়াই এর অন্যতম কারণ। এছাড়াও নৌ-চলাচল ব্যাহত হওয়াসহ হুমকির মুখে পড়েছে নদীর তলদেশের জীববৈচিত্র্য। মেঘনা নদীর সঙ্গে মিশেছে গোমতী নদীসহ জেলার উত্তরাঞ্চলের তিতাস নদী, কাঠালিয়া নদী, দাউদকান্দি, মেঘনা, তিতাস ও হোমনা উপজেলার অভ্যন্তরের ছোট-বড় কমপক্ষে শতাধিক শাখা নদী। মেঘনা নদীসহ এসব শাখা নদীর বিভিন্ন অংশে অবৈধভাবে মাছ শিকারের জন্য অন্তত দুই শতাধিক ঝোপ রয়েছে। কোথাও কোথাও মাঝনদীতে ঝোপ দিয়ে চলছে মৎস্য শিকারের মহোৎসব। ঝোপ তৈরির শুরুতে নদীতে গাছের ডালপালা ফেলে চারদিকে বাঁশের বেড়া, ঝাঁটা ও কচুরিপানা দিয়ে তৈরি করা হয় মাছের অভয়াশ্রম নামীয় ফাঁদ। তারপর ঝোপের ভেতরে ঘ্রাণযুক্ত মৎস্য খাবার দিয়ে আকৃষ্ট করা হয় মাছকে। নিরাপদ আশ্রয় ভেবে মাছেরা এখানেই আশ্রয় নেয়। কিছুদিন পর চারিদিকে সূক্ষ্ম জাল দিয়ে ঘিরে ফেলে নিধন করা হয় নানা প্রজাতির মাছ ও মাছের পোনা ও লার্ভা। একটি বড় ঝোপ থেকে এক কাটাইয়ে প্রায় ১০ থেকে ২০ লক্ষ টাকার মাছ শিকার করা হয়। আর এটা সম্ভব হয় অবৈধ ঝোপঝাড়ের সঙ্গে জড়িত এলাকার প্রভাবশালীদের কারণে। উপজেলায় দুই হাজার নিবন্ধিত সাধারণ জেলে থাকলেও এদের কোন ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেনি।
এই সাধারণ জেলেদের নেই কোন অভিযোগ দেওয়ার জায়গা বা অভিযোগ দিলেও এতে কর্ণপাত করার নেই কেউ। কারণ নদীর বড় মাছ বলে কথা। কত সুস্বাদু এই মাছ গুলো! যায় বড় বড় কর্তা ব্যক্তিদের বাসায়। শুধু মাছ নয়, সঙ্গে টাকার বান্ডিলও যায় ! এসব অন্যায় দেখার কেউ না থাকায় মাছের অবাধ বিচরণ ও প্রজনন বিঘ্নিত হয়ে মৎস্য সম্পদ আজ হুমকির মুখে। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে জীববৈচিত্র্যও। এছাড়া নিয়মনীতি উপেক্ষা করে বড় কর্তাদের যোগসাজশে যত্র-তত্র অপরিকল্পিত ঝোপের কারণে নদীতে পানির গতি যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি পণ্যবাহী নৌকা, ট্রলার, জাহাজ, বালুবাহী ভলগেট চলাচলেও মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার কেউ না থাকার কারণে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। রক্ষকই যখন ভক্ষক সেখানে আইনকর্তাদের কাছে নালিশ করেই বা কি হবে। প্রতি মাসেই নদী রক্ষা কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হলেও নেই কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা। আর মৎস্য বিভাগ! এ-তো চলছে খুড়িয়ে-খুড়িয়ে। যার প্রমাণ এই উপজেলায় বিদ্যমান। দেখা গেছে এ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে ৩ বছর ধরে নেই অফিস সহায়ক। উপরন্তু ১০ বছর ধরে এই অফিসের অফিস সহকারী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে নিযুক্ত রয়েছেন।
নদী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাধিক উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, ‘নদী দখলমুক্ত করতে মোবাইলকোর্ট পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনসহ নদীরক্ষা কমিশনের নির্দেশনা থাকলেও প্রয়োজনীয় লোকবল ও অর্থ সংকটের কারণে তা হয়ে উঠছে না। প্রভাবশালীদের অবৈধ দাপট প্রতিহত করে অভিযান পরিচালনার জন্য মৎস্য বিভাগের লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকায় অন্যের উপর ভর করে নির্দেশনা অনুযায়ী এ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে মৎস্য বিভাগকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।