![](https://dainikajkermeghna.com/wp-content/plugins/print-bangla-news/assest/img/print-news.png)
প্রায় ১৫০ ফুট উপর থেকে স্বচ্ছ পানি আছড়ে পড়ছে। তার স্বচ্ছ জলধারা দুপুরের রোদে হীরার মতো চমকাচ্ছে কালো পাহাড়ের দেয়ালে। ঝরনার গর্জন যেন আপন মনে বাজানো মন মাতানো সুর। যে কি-না বনের তৃষ্ণা নিবারণে বয়ে চলেছে বহুকাল ধরে। ঝরনার সেই পানি থেকে সৃষ্ট জলকণা তৈরি করছে কুয়াশার আবরণ। এমনই চোখজুড়ানো দৃশ্য দেখতে আপনাকে যেতে হবে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বন বিটের গহীন অরণ্যঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হামহাম জলপ্রপাতে। তবে এসব অ্যাডভেঞ্চার ট্রিপে একা নয়; দলীয়ভাবে গেলেই ভ্রমণ হবে উপভোগ্য।
![](https://dainikajkermeghna.com/wp-content/uploads/2019/07/hamham-in-4-20190723162901-300x225.jpg)
গত কয়েক মাস ধরেই অপেক্ষায় ছিলাম কবে আসবে বর্ষা আর যাব ঝরনার কাছে। কারণ ঝরনা বর্ষায় যৌবন ফিরে পায়। বর্ষা আর বৃষ্টি এলে ভাবনায় মিলে গেল হামহাম ঝরনায় যাওয়ার এই তো সময়। হামহাম ঝর্ণায় যাওয়ার পেছনে আরেকটু ইচ্ছে ছিল পাহাড়ি ট্রেইল। যেহেতু হামহাম ঝরনায় যেতে হলে আড়াই ঘণ্টা পাহাড়ি পথে হাঁটতে হয়, তাই আমাদের চাওয়ার সাথে মিলে যায়।
কিন্তু এসব ট্যুরে তো একা যায় যাও না। ভ্রমণপিপাসু কিছু বন্ধু প্রয়োজন। তার জন্য ফেসবুকে আমাদের অলাভজনক ভ্রমণ গ্রুপ ‘বাঙ্গাল : বাঙ্গাল ট্রাভেলার্স’ থেকে একটি ইভেন্ট খুলে দিলাম। পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই যেতে রাজী হলেন। আমাদের ইচ্ছে ছিল টিম ২০ জনের বড় করব না। কিন্তু কাকে রেখে কাকে না করব? তাই ২৫ জন হয়ে গেলেও কাউকে বাদ দিতে পারলাম না। সবাই মিলে ১২ জুলাই হামহাম যাব ঠিক করলাম। কিন্তু মৌলভীবাজার পাহাড়ি ঢলে আক্রান্ত। এ সময় যাওয়া ঠিক হবে না। তাই সবাই মিলে তারিখ ঠিক করলাম ১৯ জুলাই। কিন্তু এ তারিখে কয়েকজনের সমস্যা থাকায় টিম একটু ছোট হয়ে নেমে এলো ১৮ জনে।
সবাই রওনা হলাম প্রকৃতিকন্যা হামহামের উদ্দেশে। ১৯ জুলাই ভোরে গাড়ি থেকে নেমে মৌলভীবাজারের একটি রেস্টুরেন্টে নাস্তা করে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে চা বাগানের ভেতরের রাস্তা দিয়ে একে একে কমলগঞ্জের কুড়মা বাজার, চাম্পারায় চা বাগান পার হয়ে পৌঁছলাম কলাবন পাড়া। চা শ্রমিকদের ছোট্ট গ্রাম কলাবন। গ্রামের শেষপ্রান্ত থেকে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের এলাকা শুরু। এ কলাবন থেকেই বনের মধ্যেই ট্র্যাকিং করতে হবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। সেখানে আমাদের গাইড অভিজিৎ অপেক্ষায় ছিলেন।
গাড়ি থেকে নেমে প্রস্তুতি নিয়ে অভিজিতের নেতৃত্বে হাঁটা শুরু করলাম। ৪-৫ মিনিটের মধ্যে বনের গভীরে ঢুকে গেলাম। শুধু সবুজ আর সবুজ। চারদিক থেকে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। এরমধ্যে পাহাড়ি ঝিরি পথের দুটি সাঁকো পেরিয়ে এলাম। যত হাঁটছি শুধু পাহাড় বেয়ে উপরে উঠিছি। টিমের আমি, তাহমিনা খাতুন, সুমন পাটোয়ারী, বিমান ধর, ওমর ফারুক, সফিউদ্দিন সোহান, আহমেদ জসিম, নাজমুল হাসান শুভ, রিয়াজ ইসলাম, ভজন কুমার, বিদ্যুৎ রহমান, মুরাদ আহমেদ, প্রশান্ত কুমার, শাহিন চৌধুরী, রুপক ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যসহ সবাই হেঁটে চলেছি।
কিছু সময়ের মধ্যে খুব ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু এ পথে কোথাও বিশ্রামের সুযোগ নেই। প্রতি মুহূর্তে সজাগ থাকতে হয়। কারণ হামহাম যাওয়ার এ পথকে বলা হয় জোঁকের রাজ্য। তবে জোঁকের ভয়কে জয় করতে পারলে যাওয়ার পথের দু’পাশের বনের দৃশ্য যে কোন পর্যটককে মুগ্ধ করতে সক্ষম। বন, পাহাড়, ঝিরিপথ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা মিলবে নানা ধরনের গাছগাছালি, বিভিন্ন পশু ও পাখির। যাওয়ার পথে আমরা বেশ কয়েকজনকে পেলাম, যারা অর্ধেক পথ থেকে ফিরে এসেছেন। তাদের কষ্ট দেখে কিছুটা ভয় পেলাম। তবে মনের জোড় ছিল। অন্যরা পারলে আমি কেন পারবো না? তবে সবার মাঝে তাহমিনা খাতুনের কথা না বললেই নয়। আমাদের টিমে এদিন সে-ই ছিল নেতৃত্বে। অসাধারণ আত্মবিশ্বাস আর সবার প্রয়োজন বোঝার ক্ষমতা তার আছে।
একপর্যায়ে দূর থেকে কানে আসত থাকল পাহাড়ের গর্জন। তখন সবার মধ্যের ক্লান্তি এসে গেছে। পাহাড়ের উপরে একটি অস্থায়ী দোকানে আমরা বসার একটু জায়গা পেলাম। সেখানে যে যেভাবে পারছি বসে গেলাম। আমাদের গাইড বললেন, দূর থেকে হামহামের শব্দ আসছে। আর কিছু সময় হাঁটলেই হামহাম। সাথে সাথে সবার মধ্যে অন্যরকম একটা শিহরণে হাঁটার গতি বেড়ে গেল। এর পরের পথটুকু খুব খাড়া আর ঢালু। ওঠার সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নামার সময় ভারসাম্য রাখা যায় না। আমরা খুব ধীরগতিতে এগোতে থাকলাম। এরপর এলো ঝিরিপথ। জলের নিচে পাথুরে পিচ্ছিল পথ। সামান্য আছাড়পাছাড় খেয়ে সবাই মিলে এগোতে থাকলাম। এরই মধ্যে ঝরনার গর্জন কানে আসছে। ঝিরিপথের জলের মধ্যে হাঁটতে থাকায় ক্লান্তিও কমছে। ঝরনার গর্জন শুনে পা আরও দ্রুত হলো। তারপর মোড় ঘুরতেই সামনে হামহাম। আমি থমকে দাঁড়ালাম। এ যেন বহুকাল পরে দেখা প্রেয়সীর মুখ। যাকে আলিঙ্গনের আগে দু’দণ্ড বসে দেখে নিতে হয়। সবাইকে রেখে আমি পানিতে ঝাপ দিলাম। চলে গেলাম ঝরনার একেবারে নিচে। যেখানে ১৫০ ফুট উপর থেকে আছড়ে পড়া একেকটি পানির ফোটাকে মনে হচ্ছে কয়েক কেজি ওজন। তবুও কাজ করছে অন্যরকম ভালো লাগা। পাগলের মতো ভিজতে শুরু করলাম। সাঁতার কাটলাম, ছবি উঠালাম। তারপর কাঁপতে কাঁপতে উঠে এসে একটা অস্থায়ী দোকানে দুর্দান্ত চা খেলাম।
এবার ফেরার পালা। ঝরনায় ভিজে শরীরের ক্লান্তি একেবারেই উধাও। সামনের খাড়াগুলোকে আর কোন ব্যাপারই মনে হচ্ছে না। খুব চমৎকারভাবে কোন সমস্যা ছাড়া উঠতে থাকলাম। এবার সবাই মিলে একটানে একেবারে কলাবন। কলাবনে জলের সঙ্কট। আমরা ঝিরির ঘোলাজলে হাত পা ধুয়ে খেতে বসে গেলাম। খাবারের মান তেমন ভালো বলা যাবে না। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় বাধ্য শিশুর মতো গোগ্রাসে গিললাম। তারপর আবার যাত্রা। এবার আমরা যাচ্ছি মাধবপুর লেকে। যাওয়ার পথে দেখলাম পাত্রখোলা চা বাগানের সেই বিখ্যাত শ্মশান। অবশেষে বাস ধরে নীড়ে ফেরা। তবে মনে রয়ে গেল হামহামের প্রতি ভালোবাসা। ভ্রমণে অংশ নেওয়া প্রত্যেক সদস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা। এমন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ সাথে থাকলে ভ্রমণ আনন্দদায়ক হতে বাধ্য।
কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সরাসরি সড়ক ও রেলপথে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ বা শ্রীমঙ্গল যেতে হবে। সেখান থেকে রিজার্ভ সিএনজি বা জীপ নিয়ে কলাবন। কলাবন থেকে গাইড নিয়ে রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতর দিয়ে হামহাম।
সতর্কতা: মনে রাখবেন, অব্যবহৃত খাবার, চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের ফিল্টার, পানির বোতলসহ অন্যান্য আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। এগুলো সাথে করে নিয়ে আসবেন এবং বাইরে কোথাও ফেলবেন। যেহেতু হামহামকে বলা হয় জোঁকের রাজ্য তাই জোঁক ছাড়ানোর জন্য সাথে লবণ বা গুল রাখবেন। জোঁক কামড়ালে হাত দিয়ে টেনে ছাড়াতে যাবেন না। লবণ বা গুল ছিটিয়ে দিলেই কাজ হবে। ঝরনায় যাওয়ার পথে বেশকিছু উঁচু-নিচু পাহাড়, বন, পিচ্ছিল এলাকা পার হতে হবে। তাই ট্রেকিং উপযোগী জুতা পরতে হবে এবং সতর্ক হয়ে পথ চলবেন। মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা ঘটলে দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফিরে আসা অনেক কঠিন হবে।