ভারতের রাজ্য পর্যায়ে আরেকটিতে তখত হারাল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ঝাড়খন্ডের বিধানসভার নির্বাচনে ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার নেতৃত্বাধীন জোটের কাছে বিজেপির পরাজয় এ জন্য দায়ী। ফলে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিজেপির উপস্থিতি আরেকটু কমল। ওপরের ছবিতে তা অনেকটাই স্পষ্ট।
২০১৮ সাল ছিল বিজেপির জন্য সবচেয়ে মধুর সময়। ওই বছর ভারতের মোট ২৯টি রাজ্যের (বর্তমানে একটি কম) মধ্যে ১৯টিতে বিজেপি হয় একা, নয়তো জোটের অংশীদার হিসেবে ক্ষমতায় ছিল। এসব রাজ্যের মধ্যে ১৩টি রাজ্যে এককভাবে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। সোমবার (২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯) ঝাড়খন্ডের নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, বিজেপির অবস্থান অনেকটাই নেমে এসেছে। ঝাড়খন্ডের ক্ষমতা হারানোর মধ্য দিয়ে জোট বা একক হিসেবে বিজেপির নেতৃত্বাধীন রাজ্যের সংখ্যা ১৪-তে নেমে এল, এর মধ্যে ১১টিতে এককভাবে। তবে ১৪ রাজ্যের অধিকাংশই ছোট রাজ্য (উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয়, মণিপুর, সিকিম)। এককভাবে ক্ষমতায় থাকার হিসেবে এ অবনমন আরও বেশি। ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা বিজেপি বা এর জোটের শাসনাধীন ছিল। বর্তমানে এটি ৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অথচ মাত্র সাত মাস আগে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। কিন্তু এই জয়কে কোনোভাবেই তাঁর দল রাজ্য বিধানসভার ভোটের সাফল্যে রূপান্তরিত করতে পারেনি—এমনকি এসব রাজ্যে মোদির ব্যাপক নির্বাচনী প্রচার সত্ত্বেও। মোদির একক ক্যারিশমায় (পড়ুন সঙ্গে অমিত শাহ) নির্ভর করে নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে গিয়ে একের পর এক রাজ্যে ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড—সর্বত্র একই চিত্র। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ও পরে যে ছয়টি রাজ্যে নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র হরিয়ানায় ভোট-পরবর্তী জোটের মাধ্যমে কোনোক্রমে সরকার গড়তে সক্ষম হয়েছে বিজেপি। অথচ লোকসভা নির্বাচনে তাদের সাফল্য ছিল অভাবিত।
নাগরিকত্ব আইন নিয়ে উত্তাল ভারতের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ভীষণভাবে গুরুত্ববহ। কাশ্মীর ইস্যু, বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ ও বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে জনমনে অস্বস্তি তৈরির ঢের আগে থেকেই রাজ্য পর্যায়ে বিজেপির পিছু হটা শুরু। গত বছরই ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ তিন রাজ্য—রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের বিধানসভা নির্বাচনে হেরে বসে বিজেপি। এর মধ্যে টানা তিন মেয়াদে শাসন করা মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে হেরে বসাটা তার জন্য বড় ধরনের বার্তা ছিল। সে সময় আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিবিরোধীরা সে স্বপ্নের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। বরং ২০১৪ সালের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে বিজেপি বিজয়ী হলে দ্বিতীয় মেয়াদে মসনদে ফিরে এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি।
এই ফেরার মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ জুটি বিরোধী পক্ষকে একটি বার্তা ঠিকই দিতে পেরেছিলেন যে রাজ্য পর্যায়ে যা-ই ঘটুক, জাতীয় পর্যায়ের হিসাবটি আলাদা। সেখানে জয় পেতে হলে ব্যক্তিগত ক্যারিশমা লাগে। এই মুহূর্তে ভারতে এই ব্যক্তি ক্যারিশমা বিবেচনায় নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
তবে ঝাড়খন্ডের বিধানসভা নির্বাচন অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। গত ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হয় ২০ ডিসেম্বর। এই সময়ের মধ্যেই বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হয়েছে সংসদে। এসেছে অযোধ্যায় রামমন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করা হয়েছে আগেই। সারা দেশে নাগরিক তালিকা (এনআরসি) করার কথা জানিয়েছে মোদি সরকার। এর প্রতিটি বিজেপির (বৃহত্তর হিন্দুত্বের) জন্য কোর ইস্যু। কিন্তু ২৩ ডিসেম্বর বোঝা গেল, ঝাড়খন্ডের নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
আগামী বছরের শুরুতে খোদ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন। ইতিমধ্যে ভোটের দামামা বেজে গেছে। বাজিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। তবে ঝাড়খন্ডের নির্বাচন ও দিল্লির রাজপথ যে বার্তা দিচ্ছে, তাতে বিজেপির আশাবাদী হওয়ার তেমন কারণ দেখা যাচ্ছে না; বিশেষ করে রাজ্য পর্যায়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল যে ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। নয়াদিল্লি থেকে প্রথম আলোর সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘গত সাত-আট মাস ধরে কেজরিওয়াল শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সরকারি পরিষেবার উন্নতিকে তুলে ধরেছেন। সরকারি স্কুলগুলোর অভাবিত উন্নতি এই পাঁচ বছরে তিনি ঘটিয়েছেন। নজর দিয়েছেন শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি মিডডে মিলের ওপর। ক্রমাগত প্রচার মারফত স্কুলে যেতে উৎসাহিত করেছেন প্রান্তিক মানুষের সন্তানদের। ভোল বদলে দিয়েছেন সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসক নিয়োগের পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে শুল্কহীন, সহজলভ্য ও সর্বজনীন করতে পেরেছেন। নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের শুল্কে তাঁর সরকার পাঁচ বছর ধরে ছাড় দিয়ে আসছে। এবার এর পরিমাণ শুধু বাড়ানোই হয়নি, ভাড়াটেরা যাতে সরকারি সিদ্ধান্তে উপকৃত হয়, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। এই পাঁচ বছরে কেজরিওয়াল সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান—দালালির অবসান। গাড়ির লাইসেন্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সরকারি সার্টিফিকেট ও পরিষেবা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছে তাঁর সরকার। এতে সব ধরনের দালালিই যে শুধু নির্মূল হয়েছে তা নয়, বেঁচেছে সময় ও অর্থ। ঘুষ ছাড়াও যে সরকারি কাজকর্ম হয়, দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার তা অনেকটাই প্রমাণ করতে পেরেছে। গরিব মানুষের দখলে থাকা ঝুগ্গি-ঝুপড়িকে আইনি মান্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি এগিয়ে। এই বিপুল কর্মকাণ্ডের প্রচারের মুখে প্রদেশ বিজেপি প্রায় অসহায়।’ মনে রাখা দরকার, গত মে মাসে দিল্লিতে লোকসভার সব কটি আসনে জিতেছে বিজেপি।
[caption id="" align="alignnone" width="640"] ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি[/caption]
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সব মিলিয়ে ভারতের রাজনীতি এখন আবার ১৯৬৭-৮৯ সময়ে ফিরে যাচ্ছে। বিষয়টি খোলাসা করলেন সেফোলজিস্ট ও স্বরাজ অভিযান দলের নেতা যোগেন্দ্র যাদব। তিনি বলছেন, ১৯৬৭-৮৯ পর্যন্ত ভারতীয় ভোটারের একজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য ভোট দিয়েছিল। এই সময়কালে দুই শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর ছেলে রাজীব গান্ধী (তিন বছরের জনতা পার্টির শাসনামল ব্যতিক্রম)। এরপর ১৯৮৯-২০১৪ পর্যন্ত ভারতীয় ভোটাররা লোকসভা ভোটে আসলে মুখ্যমন্ত্রী (রাজ্যের প্রধান) নির্বাচন করেছেন। তাঁরা মিলে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেছেন। অর্থাৎ জোট সরকারের আমলে মিলেজুলে ‘নড়বড়ে’ প্রধানমন্ত্রীর উদাহরণ দিতে চেয়েছেন যোগেন্দ্র যাদব। এই ‘নড়বড়ে’ প্রধানমন্ত্রীর বৃত্ত ভেঙে ২০১৪ সালে বেরিয়ে আসেন ৫৬ ইঞ্চির ছাতির অধিকারী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি, একক ক্যারিশমায়। অর্থাৎ ২০১৪ থেকে এখনো পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনে ১৯৬৭-৮৯ সালের ধারাই (শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী) ফিরে এসেছে। এই ধারা কত দিন অব্যাহত থাকবে বা মোদির বিকল্প বিরোধী কোনো নেতা উঠে আসবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। অর্থাৎ ভারতের রাজনীতি কেন্দ্র ও রাজ্যের পৃথক সমীকরণ আপাতত চলতে থাকবে। সেটারই প্রমাণ, কেন্দ্রে বিপুল ক্ষমতাধর বিজেপি বসে থাকলেও রাজ্য পর্যায়ে তাদের একের পর এক দুর্গ ভেঙে পড়ছে। এ ঘটনাকে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের মিলান বৈষ্ণবও বর্ণনা করেন, ‘পুরোনো রাজনৈতিক ধারার ফিরে আসা’ হিসেবে।
তাই রাজ্য পর্যায়ের এই বিজয় নিয়ে বিজেপিবিরোধীদের তেমন আনন্দিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, রাজ্য পর্যায়ে হিন্দুত্ববাদ/জাতীয়তাবাদ বা জাতীয় নিরাপত্তার আরক তেমন কাজ না করলেও জাতীয় পর্যায়ে তা এখনো বেশ কার্যকর। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভীষণ শক্তিশালী রাজনৈতিক দল জাতীয় পর্যায়েও সফল হবে—এমন কোনো সার্থক সমীকরণ ভারত আজও দেখেনি। তাই জোটবদ্ধতার পথ দিয়েই বিজেপিবিরোধীদের এগোতে হবে। কিন্তু বিরোধী পক্ষকে শতধাবিভক্ত করার মধ্য দিয়ে সে কাজটি বিজেপি অনেকটাই কঠিন করে রেখেছে।