গত শনিবার নির্বাচনী প্রচার সমাবেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। কপাল ভালো, তিনি রক্তাক্ত হলেও গুরুতর আহত হননি। তবে সমাবেশে উপস্থিত এক ব্যক্তি এবং ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া বন্দুকধারী মারা গেছেন।
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হামলার নিন্দা করেছেন। এ সময় তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে ‘ডোনাল্ড’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই দুই নেতার চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাইডেনের মুখে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম উচ্চারণ একটি বিরল ঘটনা।
মূলধারার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এবং রাজনৈতিক মহলের অন্য পণ্ডিতেরাও ট্রাম্প এবং ঘটনার শিকার হওয়া অন্য ভুক্তভোগীদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এই রাজনৈতিক সহিংস ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন।
উল্টো চিত্রও দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই নানা ধরনের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব সামনে এনেছেন। ট্রাম্পবিরোধীদের একটি বড় অংশ এ ঘটনাকে ট্রাম্পের সাজানো নাটক বলে সন্দেহ করছেন। অন্যদিকে এফবিআই নিহত বন্দুকধারী ২০ বছর বয়সী টমাস ম্যাথিউ ক্রুকসকে একজন নিবন্ধিত রিপাবলিকান হিসেবে চিহ্নিত করার পরও ট্রাম্প–সমর্থকেরা মনে করছেন, এটি বামপন্থীদের কাজ।
উভয় শিবিরের এই সংশয় বলে দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন গভীর রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে পড়ে গেছে। দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর প্রচারশিবির সামনের দিনগুলোয় এ ঘটনা থেকে সর্বোচ্চ ফায়দা তুলতে চাইবে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের এই ফায়দা হাসিলের মধ্যেও উভয় দলকে রাজনৈতিক সহিংসতার বাড়বাড়ন্তকে আমলে নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সংকট সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
গুলি থেকে বেঁচে যাওয়া ট্রাম্প এ হত্যাচেষ্টার ঘটনা থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন। যখন নিরাপত্তা এজেন্টরা ট্রাম্পকে মঞ্চ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর সমর্থকেরা ‘ইউএসএ, ইউএসএ’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন। এরপরই ট্রাম্প এখন দুনিয়ার সব মানুষ ও মিডিয়ার মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছেন।
মজার বিষয় হলো, মিডিয়ার স্পটলাইট ট্রাম্পের ওপর গিয়ে পড়ুক, সেটি বাইডেনের প্রচারণাশিবিরও চাইছিল। কারণ, বাইডেনের ওপর যত দৃষ্টি পড়ছিল, ততই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করার মতো শারীরিক অবস্থা আছে কি না, সেটি আলোচনায় আসছিল। আর এতে তাঁর জনসমর্থন দ্রুত পড়ে যাচ্ছিল। এখন আশা করা হচ্ছে, ট্রাম্পের ওপর মিডিয়ার সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়ার সুবাদে তাঁর চরমপন্থা, তাঁর আইনি জটিলতা, তাঁর দলের চরম ডানপন্থী এজেন্ডা, ২০২৫ সালকে ঘিরে তাঁর বিশদ পরিকল্পনার কথাই বেশি বেশি আলোচিত হবে।
ট্রাম্প এই হত্যাচেষ্টার শিকার হলেও তিনি হলেন সেই প্রার্থী, যিনি রাজনৈতিক সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সমর্থকেরা ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি বিদ্রোহের সময় ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ করেছিলেন। সে হামলায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ট্রাম্প প্রশংসা করেছেন। একজন অনুপ্রবেশকারী এক নারীকে অপহরণ করার সময় সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির স্বামীকে হাতুড়িপেটা করেছিল এবং সেই মারাত্মক হামলা নিয়ে ট্রাম্প ঠাট্টা ও উপহাস করেছিলেন।
উল্লেখ্য, ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানোর ঘটনার পর প্রথম যে কয়জন রাজনীতিক তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, ন্যান্সি পেলোসি তাঁদের একজন। তিনি ঘটনার পরপরই তাঁর এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করেছেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হওয়া পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে আমি জানি এবং মানি, আমাদের সমাজে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার স্থান থাকতে পারে না।’
ট্রাম্পের জন্য ক্ষতি হতে পারে—এমন যেকোনো কিছু তাঁর অনুসারীদের মধ্যে অনুভূত হলে সাধারণত সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া জানান। শনিবারের সমাবেশে গুলি চালানোর ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকেরা বলেছেন, ঘটনার পরপরই ট্রাম্প–সমর্থকেরা তাঁদের হুমকি দেওয়া শুরু করেন।
তবে এখন পর্যন্ত ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যকে সংযত রাখার পথ অনুসরণ করছেন। তিনি তাঁর ভাষণে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন এবং ‘মন্দকে জয়ী হতে দেবেন না’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এই গুলির ঘটনায় তিনি তাঁর সমর্থকদের সহিংস হওয়া থেকে বিরত থাকতে বলবেন কি না, তা দেখার বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।
ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার বদলে দেশের শান্তি ও নিরাপত্তাকে এগিয়ে রাখার সুযোগ ট্রাম্পের সামনে রয়েছে। মৃত্যুর একেবারে কাছ থেকে ফিরে আসার এ ঘটনা সম্ভবত তাঁকে তাঁর সমর্থকদের উন্মত্ত করে তোলার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ফিরিয়ে আনবে। এরপরও যদি ট্রাম্প তাঁর বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলান, তাহলে শনিবারের গুলির মুহূর্তটিই হবে আমেরিকার বিপজ্জনক সময়ের সূচনালগ্ন।
● ক্রিস্টোফার রোডস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ