নারী নরসুন্দর, জয়িতা শেফালী রানীর গল্প

বাংলাদেশ

নারী নরসুন্দর। পুরুষের চুল কাটছেন। রাজধানী বা বড় কোনো শহরে নয়, মফস্বলের ছোট বাজারে। সংগ্রামী এই নারীর নাম শেফালী রানী। ১৫ বছর ধরে পুরুষের চুল দাড়ি কাটছেন ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার দোগনা বাজারে। এ কাজেই চলছে তাঁর ছয় সদস্যর সংসার।

তিনি আধুনিক বিভিন্ন স্টাইলের চুলের কাট দিচ্ছেন তরুণ-যুবকদের। কম টাকায় চুল দাড়ি কাটিয়ে স্বস্তিও পাচ্ছেন স্থানীয়রা। সামান্য আয়ে অভাব-অনটনের মধ্যে কেটে যাচ্ছে তাঁর দিন। শেফালী রানীর দাবি, আর্থিক সহায়তা পেলে তিনি দোগনা বাজারে একটি আধুনিক সেলুন গড়ে তুলবেন।

 

এদিকে হাল না ছাড়া এই নারীকে ‘জয়িতা’ সম্মাননা দিয়েছে জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর।

জানা যায়, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শেফালী রানী শীলের বিয়ে হয়। স্বামী বিশ্বনাথ শীলের দোগনা বাজারে সেলুন ছিল। অন্যের চুল দাড়ি কেটে স্বামী যা আয় করতেন তা দিয়ে কোনোরকম  চলে যেত তাদের সংসার। একে একে তাদের ঘরে জন্ম নেয় চার মেয়ে ও এক ছেলে। ১৫-১৬ বছর আগে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন স্বামী বিশ্বনাথ। বন্ধ হয়ে যায় শেফালীর সংসারের চাকা। নিজের চিকিৎসা এবং সংসারের খরচ চালাতে না পেরে নিরুদ্দেশ হয়ে যান বিশ্বনাাথ।

বিয়ের আগে অথবা বিয়ের পরে শেফালী কখনো চিন্তাও করেননি পুরুষের চুল দাড়ি কেটে তাঁকে সংসার চালাতে হবে। অথচ এখন দোগনা বাজারে অন্যের চুল-দাড়ি কেটে চালাচ্ছেন সংসার ও পাঁচ ছেলে মেয়ের পড়াশোনার খরচ। এর মধ্যে মেজ মেয়ে বিথিকা বিএ তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। অন্য ছেলে-মেয়েরাও পড়ালেখা করছে।

প্রতিদিন সকালে যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হন দোগনা বাজারে। সেখানে এক প্রবাসীর বসতঘরের বারান্দায় সারাদিন পুরুষের সৌন্দর্য্য বর্ধনে কাজ করেন নরসুন্দর শেফালী।

স্থানীয়রা জানায়, শেফালীর শুরুটা ছিল খুবই কঠিন এবং ব্রিব্রতকর। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পরে  ছেলে-মেয়ে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করেন শেফালী। নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নেন স্বামীর পেশাকেই ধারণ করবেন। বাজারে পুরুষের চুল দাড়ি কাটার কাজ শুরু করলে প্রথমে বাধা-বিপত্তি আসে। স্থানীয় সমাজপতিদের হস্তক্ষেপে বাধা দূর হয়। এখন শেফালী রানীর সামনে কোনো বাধা নেই। অনেকেই তাঁর প্রশংসা করছেন। নারী হয়ে পুরুষের সৌন্দর্য্য বর্ধনের সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ায় জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর তাকে দিয়েছে জয়িতা সন্মানানা। তবে শেফালী রানী এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি দপ্তর থেকে আর্থিক সহায়তা পাননি। ইচ্ছে করলে তাকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করতে চায় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর।

শেফালীর সেলুনে চুল কাটতে আসা কৃষক তৈয়ব আলী হাওলাদার বলেন, বাইরে যে টাকা দেব, সে টাকাটা শেফালীকে দিই। যখন চুল কাটা আর শেভ করি তখন ৫০ টাকা, আর শুধু শেভ করলে ২০ টাকা। শেফালী না থাকলে আমাদের ভান্ডারিয়া উপজেলায় গিয়ে চুল ও দাড়ি কাটাতে হতো। এখন আমরা গ্রামে বসেই এ কাজ করাতে পারছি।

দোগনা গ্রামের যুবক রাসেল খান বলেন, শেফালী কাকি মেসি, নেইমার, রোনালদো, রক স্টাইলে চুলের কাট দিতে পারেন। এ ছাড়াও অন্যকোনো চুল কাটের ছবি দেখালেও তিনি সেই ধরনের কাট দিতে পারেন। অল্প টাকায় শেফালী কাকি আমাদের চুল কেটে দেন। আমরা তাঁর কাছেই চুল কাটি।

স্থানীয় অটোচালক রুবেল হাওলাদার বলেন, আমরা শেফালী দিদির কাছেই চুল কাটি। তিনি আমাদের যত্নসহকারে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক কাট দেন। চুলও ভালো কাটেন এবং শেভও ভালো করেন। দোগনা গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই তাঁর কাছে চুল-দাড়ি কাটে।

শেফালী রানী শীল বলেন, প্রথমে মানুষ হাসাহাসি করত যে মহিলা মানুষ পুরুষের চুল কাটে। তা ছাড়া ধর্মীয় রীতিনীতি বিধি-নিষেধ ছিল। কেমন হবে। ভালো হয়, না খারাপ হয়, এখন তো দেখে ভালোই হয়। তাই সবাই চুল কাটতে আসে। গ্রামের বাজারে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। হাটের দিন একটু কাজ বেশি হয়। আবার দু-এক দিন গ্রাহকই হয় না। তখন অবসর সময় বাজারে বিভিন্ন দোকানের ব্যবহৃত পানি এনে দেই। এতে একটু বাড়তি আয় হয়। এখান থেকে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে পাঁচ ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চালাচ্ছি। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এক মেয়ে বিএ পড়ে, অন্যরা স্কুলে পড়ালেখা করছে। একার আয়ে সংসার চলছে না।

শেফালী রানী আরো বলেন, আমার নিজের কোনো জায়গা নেই, নিজের বাড়ির বারান্দায় আমাকে সেলুন করার স্থান দিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন নামে প্রবাসী। অন্যের জমিতে কোনো রকমের সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছি। আমাকে একটি সেলুন ও বসতঘর তৈরি করে দিলে অন্তত বাকি জীবনটা ভালোভাবে চালিয়ে নিতে পারতাম।

শেফালী রানীর মেয়ে বিথীকা শীল বলেন, আমার মাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। বাবার অবর্তমানে তিনিই আমাদের মানুষ করেছেন। নিজে অনেক পরিশ্রম করলেও আমাদের কোনো কাজ করতে দেননি। এমন মা সব ঘরে জন্ম নেওয়া প্রয়োজন। আমরা সরকারি চাকরি পেলে মাকে আর কোনো কাজ করতে দেব না।

ঝালকাঠির সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সহসভাপতি হেমায়েত উদ্দিন হিমু বলেন, শেফালী রানীর মতো সাহসী নারীদের এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সবার সহযোগিতা। সমাজের সব কাজেই এখন নারী পুরুষের সাথে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে, শেফালী রানী তার একটি বড় দৃষ্টান্ত।

জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেন, শেফালী রানীর এমন সাহসী পদক্ষেপের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে জয়িতা সম্মাননা দিয়েছে জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। প্রয়োজনে তাঁকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়েও সহায়তা করা হবে।সূত্র: কালের কন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.