জন্ম থেকে প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীকে যুদ্ধ করে যেতে হয়। যুগে যুগে কালে কালে সংগ্রামে বা কঠিন সময়ে নারী যেমন সেবার হাত বাড়িয়েছে তেমনি অস্ত্র হাতেও শত্রুর মোকাবেলা করেছে। সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের পাশাপাশি সফলতার সাথে কাজ করছে। সমাজের বাধা-বিপত্তি ঠেলে সামনে এগিয়েছে, দৃষ্টান্ত হয়েছে আরও অসংখ্য নারী ও পুরুষের কাছে।
তবে এখনো সমাজের একটা বড় অংশ নারী স্বাধীনতার বিষয়ে মগজে সংকীর্ণ ধারণা পোষণ করছে। নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংশয় দেখানো যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এক শ্রেনীর লোকেদের। তাদের ধারণা নারী কোন প্রয়োজনেই আসেনা, নারীর কাজ কেবল শোভাবর্ধন। কিন্তু না। যুগ যুগ ধরে নানান ক্ষেত্রে নারীদের সফলতা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অনেক নারী। হাজার হাজার বছর ধরে নারীদের সফলতার সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে।
বেগম রোকেয়া নারী-জাগরণ ও নারী-অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। বাঙালি মুসলমান সমাজে নারী-পুরুষের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন তিনি। নারী স্বাধীনতার পক্ষে তিনি পথ দেখিয়ে গেছেন। ০৯ ডিসেম্বর সাহিত্যিক ও শিক্ষানুরাগী বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে তার জন্ম। সামাজিক ও পারিবারিক বাধার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও বাড়িতেই বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় পড়ালেখা করেছেন তিনি। বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষা ও নারী আন্দোলনের পথ নির্দেশক।
বাংলার প্রখ্যাত মহিলা কবি সুফিয়া কামাল, ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে শায়স্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কেবলমাত্র কবিই নন, একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজ সেবক, শিক্ষক ও সংগ্রামী নেতৃত্ব । তিনি প্রেম, প্রকৃতি, ব্যক্তিগত অনুভূতি, বেদনাময় স্মৃতি, স্বদেশের প্রতি মমতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা এবং ধর্মীয় আবেগ নিয়ে আজীবন লেখালেখি করেছেন। কবি সুফিয়া কামাল অসংখ্য নারীর আবেগ, অনুভূতি, ভালো লাগা মনোবল ও আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ৮৮ বছর বয়সে এই মহীয়সী মৃত্যুবরণ করেন।
জাহানারা ইমাম, ৩ মে ১৯২৯ সালে মুর্শিদাবাদে (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে লেখিকা, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী। তিনি বাংলাদেশে শহীদ জননী হিসেবে পরিচিত। তিনি আজও মৌলবাদ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলার ইতিহাসে যোদ্ধা থেকে জ্যোতিষী পর্যন্ত গুনী ও বিপ্লবী নারীদের সংখ্যা গর্ব করার মতো। সংগ্রামী ও আদর্শিক এসব নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ খনা, চন্দ্রাবতী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ইলা মিত্র, কামিনী রায়, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সাইদা খানম, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সহ প্রমুখ নারী পথিকৃৎ। আজকের নারী জাগরণের এই যে সুউচ্চ ইমারত নির্মাণ হচ্ছে এরা প্রত্যেকেই তার একেকটি ভিত।
বর্তমান যুগের নারীরা সেই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সকল নারীর অবদান অপরিহার্য। সাঁতরে সমুদ্র পাড়ি দেয়া থেকে শুরু করে এভারেস্ট বিজয়, রাজপথে আন্দোলন সহ সকল ক্ষেত্রে রয়েছে নারীর দৃপ্ত পদচারণ।
নারী জাগরণের এতসব গৌরবময় ইতিহাস থাকলেও নারীদের চলার পথ আজও মসৃন হয়নি।
আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর ছুঁই ছুঁই । স্বাধীনতার এতো বছর পরেও নারীদের ভাগ্যের তেমন কোন পরির্তন ঘটেনি। নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আজও লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ এসব ঘটনা ঘটে চলছে প্রতিনিয়ত। এর কারণ সমাজের পশ্চাৎপদ মনোভাব। কন্যাশিশুদের সাহসী হয়ে উঠবার শিক্ষা না দেয়া। ধর্ষণ ঠেকাতে অভিভাবকরা মেয়েদের আবদ্ধ করে রাখাটাকেই সহজ সমাধান মনে করে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন ও অনিরাপত্তার কথা ভেবে মেয়েদের অন্দরমহলে রেখে বড় করাকেই নিরাপদ মনে করে। কিন্তু তারা ভাবে না এটি মেয়েদের স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ করে রেখে মেয়েদের নিরাপদ রাখা যায়না। বরং অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো সাহসী ও যোগ্য করে গড়ে তোলাই সমাধানের পথ। সরকার ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে এর প্রতিরোধে আরও জোড়ালো পদক্ষেপ নিতে হবে। ধর্ষণকারীকে ক্রসফায়ার দেয়ার পক্ষে রয়েছে বিপুল মানুষ।চারদেয়ালে আবদ্ধ হয়ে নারী থাকবে না বরং নারীলোভী পুরুষ থাকবে।
প্রতিবছরের ৮ মার্চ বেশ ঘটা করে নারী দিবস পালন করা হয়, নারীর অধিকার ও এগিয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলা হয়। অথচ সেই অধিকার বাস্তবায়ন কেউ করে দেয়না। নারীর ভাগ্যের পরিবর্তন নারীর নিজেকেই করতে হয়। নারীর মুক্তি আজও ঘটেনি, যুগের পরিবর্তনে কেবল নতুন মোড়কে নতুন রূপ ধারণ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় নারীরা আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তবে নারীদের শোষণ এখনো দূর হয়নি। নারী এখন পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র তথা বিভিন্ন দিক দিয়ে এগিয়ে গেলেও, নারী তার প্রকৃত স্বাধীনতা এখনো লাভ করেনি। বর্তমানে অনেক নারী ঠিকই উপার্জন করছে। তবে সে এখনো পুরোপুরি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়। যেমনটা পুরুষ স্বাধীন। অধিকাংশ নারীকে এখনো উপার্জিত সকল অর্থ তুলে দিতে হয় পুরুষের হাতে।
রাজনীতিতে নারীর সমান অবদান থাকলেও সমান অবস্থান এখনো হয়নি। রাজনীতির মাঠে একজন পুরুষের চেয়ে একজন নারীর শ্রম ও ত্যাগ বেশি থাকলেও শীর্ষ পদে নারীদের সংখ্যা হাতে গোনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান ক্ষমতাবান নারী হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ খুবই হতাশাজনক। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াকে আমরা উদাহরণ বলি। মূলত তারা ব্যতিক্রম। ইংরেজিতে একটি কথা আছে— "Exceptional is not example. " নির্বাচনী বিধিমতে কোন দলই ৩৩% নারী কোটা পূরণ করতে পারেনি। বিগত ৩০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশ নারী প্রধান শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেলেও কার্যত মন্ত্রীসভায় নারীর উপস