ঢাকা দক্ষিণ সিটির জন্মনিবন্ধন নিয়ে পাসপোর্টসহ সব জটিলতা কাটল

জাতীয়

প্রায় এক বছর পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জন্মনিবন্ধন নিয়ে জটিলতা দূর হলো। গতকাল বুধবার স্থানীয় সরকার বিভাগের এক অফিস আদেশে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রম কেন্দ্রীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সার্ভারের মাধ্যমে পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ সিটিতে যত নিবন্ধন হয়েছে, তার তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে জমা করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে দক্ষিণ সিটির নিবন্ধনের সব ফিও সরকারের নির্ধারিত কোডে জমা দিতে হবে।

দক্ষিণ সিটির আওতায় বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয়ে করা জন্মনিবন্ধনের তথ্য এতদিন কেন্দ্রীয় সার্ভার বা সফটওয়্যারে জমা না হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কাজে তা ব্যবহার করা যেত না। বিশেষ করে পাসপোর্ট করা যেতে না। অনেকে দক্ষিণ সিটিতে করা জন্মনিবন্ধন নিয়ে পাসপোর্ট করতে গেলে, ‘ব্যক্তির তথ্য পাওয়া যায়নি’ জানিয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ফেরত পাঠানো হতো। একপর্যায়ে পাসপোর্ট করার প্রয়োজনে অনেকে দক্ষিণ সিটির বাইরে অন্য এলাকায় বা গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় জন্মনিবন্ধন করেছেন।

জানা গেছে, দক্ষিণ সিটির মেয়র ফজলে নূর তাপসের অবস্থানের কারণে স্থানীয় সরকার বিভাগ একাধিকবার চিঠি দিলেও কোনো কাজ হয়নি। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারাও আইন ও বিধির যুক্তি দিয়ে মেয়রকে বোঝাননি। মেয়র যা বলেছেন, তাতে সায় দিয়েছেন। পৃথক সিস্টেম তৈরি করে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ চলছিল। ওই সিস্টেমের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষিণ সিটিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করা ব্যক্তির তথ্য দেখতে পেত না। কারণ, দক্ষিণ সিটি ছাড়া সারা দেশের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনসংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের হাতে। সাময়িকভাবে শুধু স্কুলে ভর্তি ছাড়া দক্ষিণ সিটির জন্মনিবন্ধন কোনো কাজে আসেনি। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে দক্ষিণ সিটির বাসিন্দারা ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন।

নতুন অফিস আদেশ অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের। আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গতকাল তাঁরা চিঠি পেয়েছেন। আজ সকাল থেকে চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো কাজ করা শুরু করেছে।

গত প্রায় এক বছরে দক্ষিণ সিটি থেকে যাঁরা জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করেছেন, তাঁদের কি আবার নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেগুলো বাতিল হবে না। ওই নিবন্ধনগুলোর তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে ১০ মাসে দক্ষিণ সিটি থেকে ৭০ হাজারের মতো জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে। এর আগের চার মাস জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ফি নিজস্ব তহবিলে জমা দেওয়ার দাবিতে নিবন্ধনের কাজ বন্ধ রাখে দক্ষিণ সিটি।

অফিস আদেশে যা বলা হয়েছে:

গতকাল স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলামের সই করা অফিস আদেশে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অধিক্ষেত্রে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রম কেন্দ্রীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সার্ভার বা সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালনা করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে গত ২৭ মার্চ, ১৩ মে ও ৫ জুন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পালন করা হয়নি, যা আইন ও বিধির সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন। ১৪ আগস্ট (গতকাল) অফিস সময়ের মধ্যে এ বিভাগের ৫ জুন পাঠানো চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের কেন্দ্রীয় সার্ভারের মাধ্যমে পরিচালনা করার নির্দেশনা দেওয়া হলো। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বাবদ ইতিমধ্যে নেওয়া সব ফি ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে নির্ধারিত কোডে জমা করে চালানের অনুলিপি অতি দ্রুত এ বিভাগে (স্থানীয় সরকার বিভাগ) পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হলো।
এত দিন যত নিবন্ধন করা হয়েছে তার তথ্য স্থানান্তর করার নির্দেশনা দিয়ে অফিস আদেশে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব সার্ভারে ইতিমধ্যে সংরক্ষিত জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন–সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য বাধ্যতামূলকভাবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের আওতাধীন কেন্দ্রীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সার্ভারে হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলো। এ ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় প্রয়োজন অনুযায়ী কারিগরি সহায়তা দেবে।

অফিস আদেশে আরও বলা হয়, এই আদেশ আবশ্যিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হলে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় বিধিগত ব্যবস্থা নেবে।

নিবন্ধন নিয়ে যা হয়েছিল:

গত বছরের জুন-জুলাই মাসের দিকে নিবন্ধনের ফির অর্থ নিজস্ব তহবিলে জমা হওয়ার দাবিতে নিবন্ধন বন্ধ রাখে ডিএসসিসি। এরপর ৪ অক্টোবর নিজস্ব সিস্টেম (সার্ভার হিসেবে অধিক পরিচিত) দিয়ে নিবন্ধনের কাজ শুরু করে ডিএসসিসি। বিষয়টিকে আইনবহির্ভূত জানিয়ে গত বছরের ১৯ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠান তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান। ওই চিঠিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ এর ৭ (ক) (২) এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮ এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারা তুলে ধরা হয়। আইনের ৭(ক) (২) ধারা অনুসারে রেজিস্ট্রার জেনারেলের দায়িত্ব ও কার্যাবলী বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। বিধিমালার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারা অনুসারে, সফটওয়্যার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ওই সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণ করার এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের।

পরে নতুন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন এ বছরের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্চ, মে ও জুন মাসে স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি পাঠিয়ে দক্ষিণ সিটির তৈরি নিজস্ব সার্ভারে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করাকে আইনবহির্ভূত বলে উল্লেখ করেন। তবে এরপরও বিষয়টিকে আমলে নেয়নি দক্ষিণ সিটি।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে থেকেই মেয়র তাপস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। সবশেষ ১৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগ অফিস আদেশ জারি করলে দক্ষিণ সিটির নিবন্ধনসংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে নেওয়া শুরু হয়।

প্রসঙ্গত পাসপোর্টসহ শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন সেবা নিতে জন্ম সনদের প্রয়োজন হয়। এই সেবাগুলো নেওয়ার জন্য ডিএসসিসিকে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ, নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, বিভাগীয় কমিশনারসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমওইউ সই করতে হবে। এ ছাড়া আইন ও বিধি সংশোধনের প্রয়োজন আছে। এই পদক্ষেপগুলো নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমোদন লাগবে।

সূত্র: প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.