নারায়ণগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত এলাকায় প্রায়ই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাচ্ছেন পথচারীরা। মূলত, অসচেতনতার কারণেই দুর্ঘটনায় পথচারীরা প্রাণ হারাচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত সীমানা নিয়ে ঢাকার রেলওয়ের থানা। ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে দেওয়া ঢাকার রেলওয়ে থানার পুলিশের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৮৮ জন। গত বছর ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ২৮২ জন। ২০১৭ সালে মারা গেছেন ৩৪৬ জন। ২০১৬ সালে ৩০৫ জন।
শিমুল সূত্রধর নামের এক শিক্ষার্থী গত ১ মে সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে মহাখালী রেললাইন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কমলাপুরগামী একটি ট্রেন ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান শিমুল।
গত ২৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টায় রাজধানীর মগবাজার এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হন সাবিল হোসেন নামের এক যুবক। তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মগবাজার রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, সড়কের দুই পাশের গেট ফেলে দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। কমলাপুর থেকে একটি ট্রেন আসছিল। তখন মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক গেট ঠেলে রেললাইনের ওপর উঠে পড়েন। বারবার তিনি তাঁদের নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কথা শোনেননি।
গত ২৭ এপ্রিল কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনচালক ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় প্রতিদিনই ট্রেনে কাটা পড়ে লোকজন মারা যেতে দেখেন তিনি। আগের থেকে এই হার বেড়েছে। দুর্ঘটনার প্রধান কারণ কানে হেডফোন লাগিয়ে মুঠোফোনে কথা বলা। চালকেরা হর্ন বাজাচ্ছেন, কিন্তু কানে হেডফোন থাকায় পথচারী কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। এ কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে লোকজন মারা যাচ্ছেন।
সদ্য বিদায়ী ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন ফারুক মজুমদার বললেন, ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের শতকরা ৪০ ভাগই মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া রেললাইনের আশপাশে অবৈধ স্থাপনা রয়েছে; বিশেষ করে বস্তি আছে। আছে বাজারও। এসব এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে লোকজন বেশি মারা যায়।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কানে হেডফোন লাগিয়ে কেউ যদি রেললাইনের ওপর দিয়ে আপনমনে কথা বলেন, তাহলে এই মৃত্যু ঠেকাবে কে? নারায়ণগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত রেললাইনের দুই পাশে অনেক বাজার ও বস্তি গড়ে উঠেছে। এসব এলাকায় ট্রেনের নিচে পড়ে হরহামেশাই লোক মারা যাচ্ছে।’
লোকজন যদি সচেতন না হয়, তাহলে কোনোভাবে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকানো যাবে না বলে মনে করেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চলতি বছর ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া ৮৮ জনের মধ্যে পুরুষ ৫৪ জন। নারী ১৪ জন। বাকিদের লিঙ্গ জানা সম্ভব হয়নি। ২০১৭ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া ৩৪৬ জনের মধ্যে পুরুষ ২৮৩ জন। নারী ৬৩ জন।
ট্রেনে কাটা পড়ে লোক মারা গেলে পুলিশ অপমৃত্যুর মামলা করে। ঘটনার তদন্ত করে রেলওয়ে থানার পুলিশ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায়। ট্রেনের কাটা পড়ে নিহত হওয়ার ঘটনার ১৪টি অপমৃত্যুর মামলার নথিপত্র সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। আদালতে দেওয়া এসব প্রতিবেদন বলছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেলক্রসিং এলাকায় বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে।
ঢাকার রেলওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, পথচারী ও যাত্রীরা সচেতন না হলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমবে না। মুঠোফোন কানে দিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটলে দুর্ঘটনা তো ঘটবেই।
গত ১৬ মার্চ টাঙ্গাইলের রসুলপুর রেলক্রসিং এলাকায় নীলসাগর ট্রেনের ধাক্কায় কাউসার আলী ও রেখা তালুকদার নামের দুজন নিহত হন। গত ২৯ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন এলাকার কুমিদি নামক স্থান পার হওয়ার সময় কলকাতাগামী মৈত্রী ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন সিএনজিচালক শামীম। তাঁর আত্মীয় আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, শামীমের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার পথে বসে গেছে। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর স্ত্রী এখন দিশেহারা।
ঢাকার আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে বলছে, জেসমিন আক্তার আসমা নামের এক তরুণী গত ২২ মার্চ দুপুরে টাঙ্গাইল রেলস্টেশন এলাকায় রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। তখন খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেসের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন জেসমিন।
রেলওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. শামসুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, অসতর্কভাবে চলাচলের কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রতিবছর নিহত হচ্ছে অনেক লোক। লোকজন সচেতন না হলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কমবে না।