ঢাকার বাসিন্দারা ব্যাপক মশা আতঙ্কে ভুগছেন। এই ভয়ের মূল উৎস এডিস মশা এবং এই মশার ছড়ানো রোগ ডেঙ্গু।
অনেক বাসিন্দাই বলছেন, এলাকায় ফগার মেশিন নিয়ে কীটনাশক ছিটানোর শব্দ ইদানীং কানে আসতে শুরু করেছে। এর বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে আর কোন কর্মকাণ্ড সারাবছর চোখে পড়েনি তাদের। এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে এডিস মশা নিধনে সঠিক কীটনাশক ব্যবহার করছে না সিটি কর্পোরেশনগুলো।
বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে রাজধানীতে এডিস মশা নিধনে ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে চেয়েছে বিবিসি বাংলা। তাদের প্রতিবেদনে এই ব্যর্থতার পিছনে ৬টি কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
১. কীটনাশক প্রতিরোধক হচ্ছে মশা
ঢাকায় শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এস এম মিজানুর রহমান বলছেন, দীর্ঘদিন একই কীটনাশক ব্যবহার করলে মশা তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, ঢাকায় বর্তমানে যে কীটনাশকগুলো মশার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, বছরের পর বছর এগুলো ব্যবহার করার ফলে এই ওষুধের বিরুদ্ধে কিউলেক্স মশা হোক বা এডিস হোক, এগুলো প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে। মশা যদি কোন কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে পরিবর্তিতে তাদের বংশধরদের আগের পুরনো একই কীটনাশক দিয়ে রোধ করা কিন্তু সত্যিই কঠিন।
২. মশা এতো 'ভয়াবহ' হবে- ধারণার বাইরে ছিল
এখনো পর্যন্ত ঢাকাতেই এর প্রকোপ সবচাইতে মারাত্মক। ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে গেলেই এর ভয়াবহতা চোখে পড়ে। হাসপাতালগুলোর বারান্দায় ওয়ার্ডে সারি সারি শুয়ে থাকা ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা করেই চেনা যায়। কারণ মশারীর ভেতরে রাখা হয়েছে তাদের এবং এরকম অসংখ্য রোগী এখানে এসেছেন। এখানে আসা লোকজন বলছেন, মশা যে মানুষকে এত ভয়াবহ একটি অসুখের সম্মুখীন করে তুলতে পারে তা তারা সেভাবে জানতেনই না।
৩. দীর্ঘ সময় ধরে বর্ষা ও গরমের স্থায়িত্ব
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক এস এম মিজানুর রহমান মনে করেন, এখন মশা নিয়ন্ত্রণে শুধু কীটনাশক নিয়ে ভাবলেই চলবে না। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর আবহাওয়া যেভাবে উষ্ণ হচ্ছে, বৃষ্টির মৌসুম যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তার সাথে এডিস মশাসহ নানা কীটপতঙ্গ বেড়ে যাওয়ার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এসব পরিবর্তন সম্পর্কে দূরদর্শী হতে ব্যর্থ হয়েছে নগর কর্তৃপক্ষ।
এই কীটতত্ত্ববিদ জানান, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, উষ্ণমণ্ডলীয় এবং অব-উষ্ণমণ্ডলীয় পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে বাড়ছে। গরমের সময়টা যদি দীর্ঘ হয়, তাহলে মশা বা কীটের জীবনকালে পরিবর্তন আসে। তাদের প্রজননকালীন সময় দীর্ঘ হচ্ছে। তাছাড়া ইদানীং বৃষ্টিপাত অনেক আগেই শুরু হয়। বর্ষা যত দীর্ঘ হচ্ছে মশার প্রজননকালীন সময় দীর্ঘ হচ্ছে। তারা আরও বেশী প্রজনন সক্ষম হয়ে উঠছে।
মশা নিয়ন্ত্রণে আপাতত জরুরী ভিত্তিতে স্বল্পকালীন ব্যবস্থা নেয়ার পর ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে বলে মত দেন তিনি।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে তাদের করা এক জরিপে দেখা যাচ্ছে বর্ষা শুরুর আগে ঢাকা শহরে প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশার সংখ্যা যা ছিল, বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর তা ছয়গুণ বেড়ে গেছে। মশার লার্ভা বা শূককীটের পরিমাণও অনেক বেশি পাওয়া গেছে। আর মূলত এ কারণেই ডেঙ্গুর এত প্রাদুর্ভাব।
৪. জরিপের ফলাফল আমলে না নেওয়া
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলছেন, এই বিষয়ে তারা আগেই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে সাবধান করেছিলেন।
তিনি বলেন, আমাদের কাজ হল চিকিৎসা করা। মশা মারার কাজ আমাদের নয়। কিন্তু যদি মানুষের রোগবালাই বেশি হয় সেই বোঝাটা কিন্তু আমাদের বহন করতে হয়। সেজন্যেই বর্ষার পূর্বে, বর্ষার সময় ও বর্ষার পরে বিশেষ করে ঢাকা শহরে মশার পরিস্থিতি কী- এই বিষয়ে জরিপ চালানো হয়।
তিনি জানান, বর্ষার পূর্বে মার্চ মাসে আমরা যে জরিপটি করেছিলাম, সেই জরিপে আমরা দেখতে পেয়েছি যে মার্চে যে পরিমাণ মশা বা মশার লার্ভা আছে তাতে বর্ষা আসলে সেই সংখ্যাটি বাড়তে পারে। আমরা সাধারণত সিটি কর্পোরেশনকে জানানোর জন্যেই এই ধরনের জরিপ পরিচালনা করি।
৫. কারিগরি সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন
সিটি কর্পোরেশনের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সময়কাল দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার সিটি কর্পোরেশনগুলো সময়মত পদক্ষেপ নেয়নি বলে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। কীটনাশক ক্রয় ও ব্যবহারে দুর্নীতির অভিযোগ এমনকি তাদের কারিগরি সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে, মশক নিধনে গত অর্থবছরে তাদের বাজেট ছিল ১৮ কোটি টাকা। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাজেটও কাছাকাছি। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তারা কীটনাশক কিনছেন। অভিযোগ উঠেছে, এডিস মশা নিধনে সেই ওষুধ আর কার্যকর নয় জেনেও কিছু করেনি তারা।
৬. সরকারি কর্মকর্তা ও সিটি কর্পোরেশনগুলো একে-অপরকে দোষারোপ
এসব অভিযোগের জবাবে ঢাকা উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মমিনুর রহমান মামুন বলছেন, ভুল বা অকার্যকর কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে এই অভিযোগ একেবারেই সঠিক নয়। যখন কীটনাশক আমরা রিসিভ করি তখন আমরা ফিল্ড টেস্ট করি। সেটা করার পর যদি আমরা সন্তুষ্ট হই, তখন আমরা ল্যাব টেস্টে পাঠাই। ল্যাব টেস্ট বা ফিল্ড টেস্ট সবই যখন ভালো হচ্ছে তখন আমার অসন্তুষ্ট হওয়ার কোন কারণ নাই।
তিনি বলছেন, মশা নিধন কার্যক্রম সারা বছরই চলে। এই মৌসুমে যে ধরনের পূর্বাভাস তাদের দেয়া হয়েছে সেই অনুযায়ী তারা পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু তবুও এডিস মশার উপদ্রব ভয়াবহ আকারে দেখা যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে কার দায়িত্ব কতটা ছিল সে নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও সিটি কর্পোরেশনগুলো একে-অপরকে দোষারোপ করছে।
ঢাকা উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মমিনুর রহমান মামুন বলছেন, তাদের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। কর্মী সংখ্যাও সাময়িকভাবে বাড়ানো হয়েছে। একবারের বদলে দুবার করে ফগার মেশিন দিয়ে কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে। নতুন ধরনের কীটনাশক আনার ব্যাপারেও কথাবার্তা চলছে।
কিন্তু এসব উদ্যোগ যে অনেক দেরিতে নেয়া হয়েছে, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে গেলেই সেটি বোঝা যায়।