ডাকাতি, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হতে চান না। সহিংসতার ভয়, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাব, আসামিপক্ষ থেকে ভীতি প্রদর্শন, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার অভাব ও বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাক্ষীরা আদালতে যেতে আগ্রহী নন। ফলে মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়, অনেক ক্ষেত্রে মামলা খারিজ হয়ে যায়। এতে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও বেশি উৎসাহী হয়।
‘ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীর অনুপস্থিতি: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক পুলিশ সদর দপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, সাক্ষীদের ৪৩ শতাংশই সাক্ষ্য দিতে চান না, ২৪ শতাংশ সাক্ষী হতে ভয় পান। আসামিপক্ষের কাছ থেকে হুমকির কথা জানিয়েছেন ২৮ শতাংশ সাক্ষী।
সাক্ষী অনুপস্থিত থাকলে মামলা ঝুলে থাকে। সাক্ষীর অভাবে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। চুরি, ডাকাতি ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় সাক্ষী হাজির করার ক্ষেত্রে পুলিশেরও আগ্রহ কম দেখা যায়।
গবেষক অধ্যাপক উমর ফারুক
যেমন ২০২২ সালের ২ আগস্ট রাতে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহনের চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় করা মামলার বাদী বাসের যাত্রী কুষ্টিয়ার বাসিন্দা মো. হেকমত আলী (২৯)। মামলাটি এখনো সাক্ষ্য পর্যায়ে। গত জানুয়ারিতে তাঁকে আদালতে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হলেও তিনি যাননি।
৭ জুলাই হেকমত প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তাহীনতা, কাজ ফেলে নিজের খরচে সাক্ষ্য দিতে যাওয়া এবং মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলার শঙ্কায় তিনি সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী নন। তাঁর ভাষায়, সেদিন বাসে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা জানেন কতটা ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, ভিডিও কনফারেন্স সাক্ষ্য নেওয়া, সাক্ষীদের যাতায়াত ও খাওয়ার খরচ দেওয়া, মামলার শুনানি নিয়মিত ও দ্রুত করা এবং আদালতে বিশ্রামাগার, পরিচ্ছন্ন টয়লেট, প্রার্থনা ও খাবারের ব্যবস্থা করলে সাক্ষীদের উপস্থিতি বাড়ানো যাবে।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইসতিয়াক আহমেদ তালুকদার।
সাক্ষীর অভাবে ন্যায়বিচার ব্যাহত
চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ ও বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার ৩০০ সাক্ষীর ওপর জরিপ চালানো হয়েছে। তাঁদের ৯১ শতাংশই পুরুষ। সাক্ষীদের মধ্যে বাদী ও অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরাও ছিলেন। সাক্ষীদের মধ্যে পুলিশ, প্রতিবেশী, বাদীর স্বজন ও পরিচিত ব্যক্তিরাও ছিলেন।
জরিপে পাঁচ মামলার পাঁচজন বাদী ও পাঁচজন সাক্ষী, চারটি ট্রাইব্যুনালের বিচারক, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), উপপরিদর্শক (এসআই-তদন্ত) এবং মানবাধিকারকর্মীদের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। প্রতিবেদনে ধর্ষণ ও যৌতুকের মামলা, মাদক, চুরি, ডাকাতি, জমিসংক্রান্ত বিরোধ ও হত্যা মামলা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে দীর্ঘদিন ধরে ফৌজদারি মামলার বিচারে সাক্ষীর উপস্থিতি ধারাবাহিকভাবে বেশ কম। এতে অনেক মামলা খারিজ ও আসামিরা খালাস পেয়েছেন। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাক্ষী না থাকায় খালাসের হার সবচেয়ে বেশি। ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ ও সাক্ষ্যের অভাবে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার মধ্যে ৫৫ শতাংশ খারিজ হয়ে গেছে। মাত্র ৩ শতাংশ আসামি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
স্বামীর নির্যাতনের শিকার এক নারী জানান, মামলার প্রধান সাক্ষী ছিলেন প্রতিবেশী। আদালতে শুনানির দিন ভয়ে সাক্ষী হাজির হননি। আদালতের নির্দেশে সাক্ষীর খোঁজ নিতে গিয়ে পুলিশ দেখে, প্রতিবেশী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রতিবেদন অনুসারে, সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় ৫০ শতাংশ ডাকাতি মামলার বিচারকাজ ব্যর্থ হয়েছে। সঠিকভাবে সাক্ষ্য না দেওয়ায় গত এক দশকে মাদকদ্রব্য বিভাগের প্রায় ৪৬ শতাংশ মামলা খারিজ হয়েছে।
গবেষক অধ্যাপক উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষী অনুপস্থিত থাকলে মামলা ঝুলে থাকে। সাক্ষীর অভাবে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। চুরি, ডাকাতি ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় সাক্ষী হাজির করার ক্ষেত্রে পুলিশেরও আগ্রহ কম দেখা যায়।
অধ্যাপক ফারুক বলেন, সাক্ষী সুরক্ষা আইন করতে হবে। বাদী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা যেন নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়টি সহজ করতে ভিডিও কনফারেন্সে আদালতে সাক্ষ্য নেওয়ার ব্যবস্থা উন্নত দেশে রয়েছে। এখানেও সেটা কার্যকর করা যেতে পারে।
অনেক সাক্ষী ভাসমান থাকেন। তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যক্তিদের সাক্ষী করার দিকে পুলিশকে নজর দিতে হবে।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের পিপি আফরোজা ফারহানা আহমেদ
বিচারে আস্থার অভাব, হুমকিও বাধা
প্রতিবেদনে তিনটি ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, জমির বিরোধসংক্রান্ত এক মামলার বাদী বলেছিলেন, আসামিপক্ষের হুমকির কারণে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে রাজি হতেন না। কর্মদিবসে সাক্ষ্য গ্রহণ চলায় দু-একবার যাওয়ার পর তাঁরা আর আগ্রহ দেখাতেন না। যাতায়াতেও সাক্ষীদের বেশ খরচ হয়ে যেত।
স্বামীর নির্যাতনের শিকার এক নারী জানান, মামলার প্রধান সাক্ষী ছিলেন প্রতিবেশী। আদালতে শুনানির দিন ভয়ে সাক্ষী হাজির হননি। আদালতের নির্দেশে সাক্ষীর খোঁজ নিতে গিয়ে পুলিশ দেখে, প্রতিবেশী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
পাওনা টাকা নিয়ে হবিগঞ্জে ২০১৯ সালে হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই মামলার সাক্ষী জানান, ঘটনার পাঁচ মাস পর আদালতের নোটিশ পেয়ে তিনিসহ দুজন সাক্ষ্য দিতে যান। ওই সময় সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর জানান, তাঁদের ডাকা হয়নি। কিন্তু ২০২২ সালে ওই সহকারী পিপি বদলির পর তাঁরা জানতে পারেন, আদালতের দুটি শুনানিতে তাঁদের অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে।
বেশ কয়েকজন সাক্ষী জানিয়েছিলেন, তাঁদের অনুমতি ছাড়াই পুলিশ তাঁদের সাক্ষী বানিয়েছে।
সাক্ষ্য দিতে বাধার বিষয়টি উল্লেখ করে সাক্ষীদের ৭৯ শতাংশ ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাবের কথা জানিয়েছেন। আসামিদের হুমকির কথা বলেছেন ৭৭ শতাংশ। ৭৫ শতাংশ জানিয়েছেন, আদালতে বিশ্রামের জায়গা নেই। ৫১ শতাংশ জানিয়েছেন, রাষ্ট্র সাক্ষীদের সুরক্ষা দেয় না।
সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পুলিশ কর্মকর্তারা কতটা ভূমিকা রাখেন, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (প্রসিকিউশন) মোহাম্মদ আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই বিভাগ থেকে সাক্ষীদের হাজির হতে থানায় সমন পাঠানো হয়। থানা থেকে সাক্ষীকে হাজির করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের পিপি আফরোজা ফারহানা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সাক্ষী ভাসমান থাকেন। তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যক্তিদের সাক্ষী করার দিকে পুলিশকে নজর দিতে হবে। আদালতে অপেক্ষার জায়গা না থাকা ও অপরিচ্ছন্ন টয়লেটের বিষয়টিও তিনি স্বীকার করে বলেন, এতে বিশেষ করে নারী সাক্ষীরা ভোগান্তিতে পড়েন।