ট্রলারে করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ

ভ্রমণ

ঢাকা থেকে আমরা শ্যামলী বাসে করে ২৫ তারিখ, বৃহস্পতিবার রওনা দেই সেন্ট মার্টিন এর উদ্দেশ্যে। আমি, সাবিহা আপু, রুৎবা আপু এবং উনার আম্মু। বাস ছাড়ার কথা ছিল ৮টায়। কিছুক্ষণ দেরি হয়। বাসে গান শুনা ছাড়া আর ঘুমানো ছাড়া তেমন কিছু করার থাকে না। সকালে বাস উখিয়া পৌঁছালে আমাদের বলে বাস থেকে নামতে। এই বাস আর যাবে না টেকনাফ। অন্য আরকেটা বাস আসছে, ঐটায় করে যেতে হবে। কারণ সম্ভবত যাত্রী কম। আমরা অল্প কয়েকজন। আমরা অন্য আরেকটা বাসের জন্য অপেক্ষা করি। নতুন বাসে উঠে দেখি সিট নেই। একেবারে পেছনের দিকে। বসলাম।

 

কিছুক্ষণ পর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। রাস্তার দুই পাশেই রোহিঙ্গা ক্যাম্প দেখা যাচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি সামনে জ্যাম। সম্ভবত কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমাদের প্রায় ১ ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে। টেকনাফ পোঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে দশটা বাজে। বাস থেকে নেমে আমরা ট্রলার ঘাটে চলে যাই। ট্রলারের টিকেট কেটে নেই। ২৩০ টাকা করে ট্রলার টিকেট। ছাড়বে ১১.১৫তে। আমরা নাস্তা করিনি। হাতে সময়ও নেই। একটা হোটেলে গিয়ে খুব দ্রুত নাস্তা করে নেই।

সাড়ে এগারোটায় ট্রলার ছাড়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর চেক পোস্ট। চেক করার পর আমরা রওনা দেই সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে। ট্রলারে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটু এডভেঞ্চার। এর আগেও একবার ট্রলারে করে গিয়েছি। যখন বড় ঢেউ এর সাথে ট্রলার ভেসে উঠত, কেমন ভয় লাগত। ভালো ও লাগত। ভয়ের সাথে ভালো লাগার কি অদ্ভুত সম্পর্ক!

 

ট্রলারে যেভাবে ছিলাম আরকি!

 

সূর্যের কি উত্তাপ। মনে হচ্ছিল পুড়ে যাবো। একটা গামছা ছিল, গামছা গায়ে দিয়ে রোদ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে এক জায়গায় বসে ছিলাম। অলস ভাবে বসে থাকতে থাকতে আর ট্রলারের উচ্চ শব্দে এক সময় ঘুম চলে আসল। বুঝলাম সুন্দর সুরের পাশা পাশি বেসুরও ঘুমাতে সাহায্য করে। সমুদ্রের মাঝে ট্রলারের শব্দ আসলে তেমন খারাপ লাগে না। নির্জনতার মধ্য দিয়ে শব্দ করে ছুটে চলা।

সেন্ট মার্টিন পৌঁছাতে পৌঁছাতে ২টা বাজল। ট্রলার থেকে নেমে মনে হলো আমরা কি ভুল করে মালদ্বীপ কোন দ্বীপে চলে এসেছি? এত সুন্দর সব কিছু। এত পরিষ্কার। এত নীল। আমরা ঢাকা থেকে হোটেল বুক করে যাইনি। সাবিহা আপু সী ভিউতে কল করে গিয়েছিল যদি। নেমে দুই একটা হোটেল দেখে দেখলাম বাজারের এদিকের ভালো হোটেল গুলো বুকড। আমরা চলে গেলাম সী ভিউতে। যেখানে থেকে সত্যি সত্যি সমুদ্র দেখা যায়। সামনে রয়েছে হ্যামক এবং বীচ চেয়ার।

দারুচিনি দ্বীপে নেমে এই দৃশ্য দেখে সব কষ্ট ভুলে গেলাম

রুমে ব্যাগ রেখেই আমি চলে গেলাম সমুদ্রে। সমুদ্রের পানি! গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। গোসল করে রুমে এসে ফ্রেস হয়ে নিলাম। ক্ষুদা লেগেছে খুব। সী ভিউ এর রেস্টুরেন্ট ছিল। ঐখানে গিয়ে খেতে বসলাম। খাবার ভালো ছিল না। হতাশ হতে হলো। খাওয়া দাওয়া করে বীচে ফিরে এলাম। বাকি সময় বীচে হাঁটা হাঁটি করেই কাটিয়ে দিলাম।

প্রবাল দ্বীপের প্রবালেরা

 

জেলে এবং তার ট্রলার
জোয়ার আসলে এই ট্রলার ঘুল ভেসে উঠে। ভাটার সময় আবার এভাবে বালির উপর সৈকতে পড়ে থাকে।
দারুচিনি দ্বীপে সূর্যাস্ত

সন্ধ্যার দিকে বীচে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বাজারে গেলাম। আকাশে তখন কি সুন্দর তারা। মিল্কিওয়ে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমার কি যে ভালো লাগছিল। ঢাকার আকাশে এত্ত বেশি তারা এক সাথে দেখা যায় না। শুধু তারা দেখার জন্য হলেও শহরের বাহিরে গিয়ে রাত কাটানো উচিত মনে হয় আমার কাছে।

বাজারে গিয়ে আল্লার দান রেস্টুরেন্টে আমরা একটা কোরাল বার-বি-কিউ করার অর্ডার দেই। ওরা জানালো সাড়ে নয়টার দিকে যেতে। চা খেয়ে এরপর আমরা জেটিতে আসি। জেটিতে এসে দেখি আকাশে বিশাল একটা চাঁদ উঠতেছে। সূর্য উঠার মত করে। চাঁদ উঠার সাথে সাথে তারা গুলো হারিয়ে যেতে লাগল। চাঁদটা সুন্দর। এরপরও তারা গুলোর জন্য খারাপ লাগলো। চাঁদটা এত কাছে। তারারা কত দূরে। এরপর ও তো তারাদের জন্য একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়।

অনেকক্ষণ আমরা জেটিতে ছিলাম। চাঁদটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে লাগল। দূরে একটা দল ফানুস উড়াচ্ছিল। অনেক চেষ্টার পর যখন একটা ফানুস আকাশে উড়ে, কি যে উল্ল্যাস তাদের। জেটিতে কেউ কেউ গান গাচ্ছিল। কেউ বসে গল্প করছিল। আর কেউ কেউ সিগারেটে টান দিয়ে হয়তো প্রিয় কারো কথা ভাবছিল।

৯টার দিকে আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি আমাদের বার-বি-কিউ রেডি। পরোটা দিয়ে খেয়ে নিলাম। ভালো লাগল। খাওয়া দাওয়া করে বীচ দিয়ে হেঁটে আমাদের হোটেলের দিয়ে যেতে লাগলাম। ততক্ষণে জোয়ার এসে গেলো। হোটেলের কাছা কাছি গিয়ে দেখলাম আর সামনে যাওয়ার উপায় নেই। পাশে একটা রাস্তা ছিল। ঐটাতে উঠে পরে হোটেলে ফিরি।

বাকি সময় কাটাই হোটেলের সামনে হ্যামকে বসে। জোয়ারে হোটেলের একেবারে সামনে পর্যন্ত পানি এসে গিয়েছে। সমুদ্রের গর্জন, সুন্দর জোছনা এসব ভালো লাগছিল। মশা ছিল। কেন জানি অডোমোস নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাহলে আরেকটু ভালো হতো।

কিছু সময় বই পড়ে, কিছু সময় জোছনা দেখেই রাত কাটিয়ে দিলাম। জোয়ারের পানি এক সময় আস্তে আস্তে কমে গেলো। খালি পায়ে ভরা জোছনায় বীচে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। সব কিছু তো আর লিখে প্রকাশ করা যায় না। তাই লিখবও না।

সকালের দিকের প্ল্যান ছিল ছেড়া দ্বীপ যাওয়ার। হেঁটে হেঁটে। সকাল হলে আমরা রওনা দেই। সৈকত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনে গিয়ে দেখি সূর্য উঠে। সূর্য উঠার দৃশ্যটা খুবি অসাধারণ। অথচ এটি প্রতিদিনের সাধারণ ঘটনা। পাহাড়ের এক কোনা থেকে একটু উঁকি দিল। খুব দ্রুতই নিজেকে পাহাড়ের আড়াল করে আলো ছড়াতে লাগল।

ছেড়া দ্বীপে এর আগে একবার হেঁটে গিয়েছি। ভাবলাম এবারও হেঁটে যাই। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। এরপর ও দেখি অনেক দূর বাকি। একটা দোকান দেখে গেলাম। এক বয়স্ক লোক দোকান খুলছেন। উনার স্ত্রীও রয়েছে সাথে। পাশেই ঘর। ঘর থেকে চা তৈরি করে আনল। আমাদের বসতে দিল। বুড়ো লোকটি সম্ভবত নামাজ পড়ে এসেছে। পাঞ্জাবি গায়ে, মাথায় টুপি। শুভ্র মানুষ। কাঁপা কাঁপা হাতে আমাদের ডাব কেটে দিল। চা তৈরি করে দিল। বসে বসে গল্প করলাম আমরা। উনার স্ত্রী নিজেদের সম্পর্কে বলল, ছেলে মেয়েদের গল্প করল। টাকা দেওয়ার সময় আমাদের থেকে শুধু ডাবের টাকা রাখল। চায়ের ফ্লাক্স নতুন কিনে এনেছে। আমরাই প্রথম কাস্টোমার। তাই আমাদের জন্য ফ্রি। ভালোবাসা।

আমরা আবার রওনা দিলাম। অনেকক্ষণ হেঁটে যখন ক্লান্ত, তখন ভাবলাম আর হাঁটা যাবে না। নৌকায় করে যেতে হবে। ছোট্ট একটা ট্রলার ঠিক করলাম আমরা। যার ট্রলার, সে গেল তেল আনত। আর যিনি ঠিক করে দিয়েছেন, উনি নিয়ে গেলো আমাদের উনাদের বাড়িতে। মেহেমানদের মত চেয়ার বের করে বসতে দিল। উনাদের গাছে ডাব ছিল। আমরা ডাব কিনে খেলাম। ট্রলার ড্রাইভার যখন আসলো, আমরা রওনা দিলাম ছেড়া দ্বীপ।

দূর থেকে ছেড়া দ্বীপ

এর আগে ছেড়া দ্বীপ সম্ভবত একটাই দ্বীপ ছিল। এখন কয়েকটা হয়েছে। ছোট ছোট দ্বীপ।

একটা ছেড়া দ্বীপ থেকে অন্য আরেকটা ছেড়া দ্বীপ

পানি গুলো কি যে স্বচ্ছ। ঐ দিকে ঢেউ গুলোও বড়। ভালো লাগল। সমস্যা একটাই। এত বেশি রোদ যে শরীর পুড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল নিগ্রো হতে বেশি দেরি নেই। ফেরার সময় ট্রলারেই ফিরেছি।

মাছ ধরছে জেলেরা

হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ ঘুমালাম। আধা ঘণ্টার মত। ১২টার দিকে বের হলাম আমরা। রুম চেকআউট করে। এরপর খেতে গেলাম বাজারে। খাওয়া দাওয়া করে নিলাম মাছ এবং ভর্তা দিয়ে। গত রাতে জাহাজের টিকেট কেটে নিলাম। ৩টায় জাহাজ ছাড়বে। খাওয়া দেওয়া শেষ করার পর দেখি ১টা বাজে। আমাদের হাতে এখনো অনেক সময়। সাইকেল চালানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এর আগে সুযোগ হয়নি। ভাবলাম যে সময় আছে, এই সময় এক ঘণ্টার জন্য সাইকেল রেন্ট করে ঘুরে আসি।

সাইকেলে করে বলা যায় দ্বীপের অর্ধেক ঘুরেছি। রাস্তা যতটুকু যায়, ততটুকু গিয়ে এরপর বীচ ধরে বাজারে ফিয়ে এলাম। মাত্র ৪০ মিনিটে। সাইকেল নেওয়ার সময় ঠিক করে গিয়েছি প্রতি ঘণ্টা ৪০ টাকা করে। আমাদের হাতে যেহেতু সময় ছিল না। এক ঘণ্টার বেশি চালাবো না, তাই ১ ঘণ্টার টাকা আগেই দিয়ে দিতে চেয়েছি। নেয় নি।। বলল ফিরে আসলে দিতে। ৪০ মিনিট পর যখন ফিরে এলাম, আমাদের জানালো আমরা নাকি দেড় ঘণ্টা সাইকেল চালিয়েছি। এবং প্রতি ঘণ্টা ৬০ টাকা করে! আমরা যতই বলি হয়তো অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলছেন হয়তো। বলল না, আপনারা ১২.৪০ এ সাইকেল নিয়েছে। এখন দেড় ঘণ্টা হয়েছে। বুঝলাম ইচ্ছে করেই এমন করছে। আমরা বললাম আসেন, জেটির দিকে আসেন। ঐখানে পুলিশ আছে, কথা বলি। আমাদের দিকে টাকা ছুড়ে মারল। কথা না বাড়িয়ে আমরা চলে এলাম। সামান্য টাকার জন্য মানুষ কেমন অভদ্র, প্রতারক হতে পারে! শেষ মুহুর্তে এসে মনটাই খারাপ করে দিল।

জাহাজটা এয়ারকন্ডিশন্ড। গরম থেকে একটু স্বস্তি ফেলাম। এক লোক ফেরার টিকেট কাটল পরের দিনের। কাটার সময় হয়তো খেলা করে নি যে কাউন্টার থেকে ওদেরকে পরের দিনের টিকেট দিয়েছে। এসব নিয়ে দৌঁড়া দৌঁড়ি করতে গিয়ে তার ছেলেকে হারিয়ে ফেলল। ততক্ষণে লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। খোঁজা খুঁজির পর যখন পাওয়া গেলো, চিৎকার করে বলল, পেয়েছি… পেয়েছি… এরপর কান্না শুরু। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের কান্না। কত দিন পর আনন্দের কান্না দেখলাম।

রাতে না ঘুমানোর কারণে কি যে ঘুম পাচ্ছিল আমার। অন্য সময় হলে সারাক্ষণ ডেকে থাকতাম। জাহাজের পেছনে পেছনে খাবারের জন্য আসা পাখি গুলোকে দেখতাম। চিপস ছুড়ে মারতাম। এসব বাদ দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভাঙল। জাহাজের পেছনের দিকে গেলাম। পাখি গুলো তখনো আমাদের পেছনে পেছনে আসতে লাগল। কেউ চিপস ছুঁড়ে মারলে সেগুলো ক্যাচ ধরে খাচ্ছিল। কি যে ভালো লাগে দেখতে। সাবিহা আপু চিপস কিনে আনলে আমরা ছুঁড়ে মারি। ভালো লাগে।

আমাদের বাস ছিল ৫.৩০ এ। ফোন করে জানাই আমরা জাহাজে। বলল বাস জাহাজ ঘাটে অপেক্ষা করবে। জাহাজ পোঁছালো 7.30 এ। দেখি প্রায় অনেকেই ছিল জাহাজে। বাসে উঠার পর ঘুমালাম ইচ্ছে মত। যাত্রা বিরতি দিলে খাওয়া দাওয়া করে আবার করে এসে আবার ঘুম!

ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৮টা বাজল। বাস যাওয়ার কথা ছিল আরামবাগ। আমাদের সায়দাবাদই নামিয়ে দিল। কারণ পরিবহন ধর্মঘট। কোন গাড়ি নেই। সিএনজি থাকলেও সেগুলো যাবে না। কারণ গেলেই তাদের সিএনজি থামিয়ে তার কেটে দেয় বা কিছু একটা নষ্ট করে দেয়। অনেকক্ষণ হেঁটে রিক্সাও পেলাম না। একটা রিক্সা ঠিক করি আবুল হোটেল পর্যন্ত। পরে উনাকে বলি আপনি যতটুকু পারেন, আমাকে বসুন্ধরার দিকে নিয়ে যান। উনি রামপুরা পর্যন্ত নিয়ে আসল। অন্য আরেকটা রিক্সা করে বসুন্ধরার ঘেটে আসি। সময় খুব একটা বেশি লাগেনি। ঢাকার মধ্যে আমার রিক্সা ভ্রমণ হয়ে গেলো। সব মিলে ভালোই ছিল ট্যুরটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.