দৈনিক আজকের মেঘনা
স্টাফ রিপোর্টার সাইফুল্লাহ মানসুর
সাতক্ষীরা অফিস : বছরের পর বছর অফিস না করে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা উত্তোলন করে যাচ্ছেন পরিবার পরিকল্পনা ইউনিয়ন পরিদর্শক মেহেদী হাসান বাবু।
তিনি সাতক্ষীরা তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক। একই সাথে মেহেদি হাসান বাবু ঢাকা হানিফ ফুডস্ এর ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। যদিও তিনি বাইরে হানিফ এন্টারপ্রাইজের এমডি সিরাজুল ইসলাম রিকু’র এপিএস পরিচয় দিয়ে থাকেন। আবার কখনো কখনো হানিফ এন্টারপ্রাইজের জিএমও পরিচয় দেন। যে কারণে বছরের প্রায় ১২ মাসই তাকে ঢাকাতে অবস্থান করতে হয়। সেখান থেকেও বেতন ভাতাসহ বিভিন্ন ফন্দি ফিকির করে বাগিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা। যার কারণে ঢাকার শ্যামলীতে বাসা ভাড়া করে থাকতে হয় তাকে। এসব কারণেই মূলত তার সরকারি নিজ কর্মস্থল তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা অফিসে সারা মাসই অনুপস্থিত থাকতে হয়। মাসের যে কোনো একদিন এসে তালা সোনালী ব্যাংক থেকে বেতন ভাতা উত্তোলন করে থাকেন মেহেদি হাসান।
মেহেদি হাসান বাবুর বাড়ি তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের হরিহরনগর গ্রামে। বাবার নাম কালাম শেখ। তার নিজ ইউনিয়ন খেশরার পরিবার পরিকল্পনা ইউনিয়ন পরিদর্শক হলেও নিজ কর্মস্থলে তাকে কখনো দেখা যায় না বলে অভিযোগ নিজ গ্রামবাসীর। মাঠ পর্যায়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিংকর্মী ও পরিবার কল্যাণ সহকর্মীদের নিয়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবার কার্যক্রম পরিচালনা ও মনিটরিং এর কথা থাকলেও সেখানে কখনো দেখা যায় না খেশরা ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা ইউনিয়ন পরিদর্শক মেহেদি হাসানকে।
প্রতি মাসে বাধ্যতামূলক স্যাটেলাইট ক্লিনিকের কার্যক্রম নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন একটি করে ওয়ার্ডে মিটিং করার বিধান থাকলেও স্যাটেলাইট ক্লিনিকের কোনো কার্যক্রমে আজও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি মেহেদি হাসানকে। অথচ এই স্যাটেলাইট ক্লিনিক কার্যক্রমের সদস্য সচিব খোদ মেহেদি হাসান। যেখানে সদস্য রয়েছেন ইউপি মহিলা মেম্বার। তাদের অভিযোগ মাঠ পর্যায়ের কোনো কার্যক্রমে মেহেদি হাসান আসেন না।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা মাসিক সমন্বয় মিটিংয়েও অনুপস্থিত থাকেন তিনি। তবে এলাকাতে নিজেকে অনেক ক্ষমতাধর বলে জাহির করেন এই মেহেদি হাসান। যে কারণে তার বিরুদ্ধে ক্ষতির ভয়ে কেউ কথা বলতে সাহস পায় না।
জানা গেছে, ফিল্ডের সমস্ত কাজ পাশ্ববর্তী খলিষাখালী ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক সুব্রত কুমার বৈদ্যকে দিয়ে করান। এমনকি অফিসের কাগজ কলমের কাজও এই সুব্রত কুমার বৈদ্য সম্পন্ন করে মেহেদি হাসানের শিখিয়ে দেয়া হুবহু ইনিশিয়াল স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিয়ে থাকেন। তার বিনিময়ে প্রতিমাসে সুব্রত কুমার বৈদ্যকে কিছু টাকাও গুণতে হয় মেহেদি হাসানকে।
২০১১ সালে ১৩ জানুয়ারি মেহেদি হাসান তালা উপজেলার খেশরা পরিবার পরিকল্পনা ইউনিয়ন পরিদর্শক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু যোগদানের পর থেকে এখনো পর্যন্ত অফিস না করে বহাল তবিয়তে বেতন ভাতা উত্তোলন করে যাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, সাতক্ষীরা জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রওশনারা বেগম ও তালা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামকে ম্যানেজ করে বহাল তবিয়তে মেহেদি হাসান ঢাকাতে আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হানিফ এন্টারপ্রাইজে চাকরিরত রয়েছেন। আর এই সীমাহীন অনিয়ম দুর্নীতি করে টিকে থাকতে তালা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামকে পাটকেলঘাটায় অবস্থিত বর্তমান বাড়িতে কয়েক দফায় দাওয়াত করে ভূরিভোজ করিয়ে নগদ অর্থ ও বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়েছেন মেহেদি হাসান।
এ বিষয়ে আমিনুল ইসলাম বলেন, মেহেদী হাসান আমার অধিনস্থ কর্মচারী। তিনি অন্য কোথাও চাকরি করেন বলে তার জানা নেই। তিনি ফিল্ডে অনুপস্থিত থাকেন বলে তার কাছে অভিযোগ রয়েছে। তবে স্থানীয়রা এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনেক কর্মচারীই জানান, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের সহযোগীতায়ই মেহেদী হাসান দপ্তরের বিধি পরিপন্থী কাজ করতে সক্ষম হচ্ছেন।
মেহেদি হাসান বছরের পর বছর অফিস না করে কিভাবে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন ভাতা উত্তোলন করছেন এ ব্যাপারে জানতে সাতক্ষীরা জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রওশনারা বেগম বলেন, মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। বিষয়টি তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অতএব তিনি উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ব্যতিরেকে অন্য কোনো দপ্তরের কর্মকর্তা সমন্বয়ে তদন্ত টিম গঠন করবেন এবং মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করা হবে বলে তিনি জানান।
তালা উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনদ কুমার জানান, মেহেদী হাসান খুবই ক্ষমতাধর মানুষ। বছরের পর বছর অফিস না করে সরকারি বেতন ভাতা উত্তোলন করছেন। তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি তালা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অমিনুল ইসলাম। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেখিয়ে তিনি এসব অনৈতিক ও সরকারি বিধি পরিপন্থী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয় জেলা পরিষদের সদস্য মীর জাকির হোসেন জানান, আমার নির্বাচনী এলাকার একটি ইউনিয়ন খেশরা ইউনিয়ন পরিষদ। সেখানকার ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক মেহেদি হাসান বাবু। তিনি খুবই ক্ষমতাবান। চাকরিতে যোগদানের পর থেকে তিনি অফিস করেন না। তার ভয়ে এলাকায় কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না।
রাজধানী ঢাকার শ্যামলী কলেজ গেইট ২২/২ বাবর রোড, ব্লক-বি এর কসমোপলিটন সেন্টারের তৃতীয় তলায় হানিফ এন্টারপ্রাইজের প্রধান কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেহেদী হাসান হানিফ পরিবহনের এমডি সিরাজুল ইসলাম রিকুর বর্তমানে একান্ত সহকারী। এ পদে দায়িত্ব পালনের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন হানিফ পরিবহনের এইচ আর ডিভিশনের কর্মকর্তা আবু সাইদ।
তিনি বলেন, মেহেদী হাসান এমডি সাহেবের একান্ত সহকারী। তার বেতন ভাতা সরাসরি এমডি সাহেব প্রদান করে থাকেন। তার বেতন-ভাতা এবং পদমর্যাদার বিষয়টি অন্য কারো জানার কথা নয়। মেহেদী হাসান ১৫ বছরের অধিকাল ধরে হানিফ পরিবহনে চাকরি করে আসছেন বলে নিশ্চিত করেছে পরিবহনের এইচ আর ডিভিশন।
হানিফ পরিবহনের ব্যবস্থাপক জামান বলেন, মেহেদী হাসান এমডি সাহেবের একান্ত সহকারী হিসেবে পরিবহন এবং ফুডস গ্রুপেও দায়িত্ব পালন করেন এবং তিনি নিয়মিত ঢাকায় অফিস করেন।