কী অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! একপাশে সন্ধ্যা নদীর সকালের স্নিগ্ধ রূপ, অন্যপাশে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে লাল শাপলা। দূর থেকেই মনে হচ্ছে, আমাদের অপেক্ষাতেই স্বচ্ছ পানির উপরে লাল শাপলা ফুলের বড় এক প্রাকৃতিক স্বর্গ সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে! ফুটন্ত শাপলা ফুলের রাজ্যের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছেলে-মেয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন নৌকায়। এপার থেকে ওপারে যাচ্ছেন, শাপলা তুলছেন তারা।
শাপলার এমন লাল দুনিয়ার দেখা মিলবে বরিশালের উজিরপুরের চার বিলে। উপজেলার সাতলা ও হারতা লাগোয়া দুটি ইউনিয়ন। এই দুটি ইউনিয়নের সাতলা, নয়াকান্দি, পটিবাড়ি পাশাপাশি তিনটি বিল। একটু দূরেই হারতা ইউনিয়নে আরেকটি বিল। নাম কালবিরা। এই চারটি বিলজুড়ে রঙিন শাপলার বর্ণাঢ্য উৎসব চলে বছরের আট মাস। বিশাল আয়তনের বিলগুলোতে ফুটে থাকা লাল শাপলা প্রকৃতির রূপকে আরো মোহনীয় করে তুলেছে।
গত তিন-চার বছরে লাল শাপলার এই অভয়ারণ্য ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। কারণ এখানে এলে দেশে মিলে এক নিটল বাংলার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্যের। সবুজ বিলে লাল শাপলাগুলো দেখে মনে হবে এই বিলের পরতে পরতে হাজার হাজার বাংলাদেশের পতাকা ছড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে যেকোনো বাঙালির। সকালের সূর্যের সোনালি রোদ আর শেষ বিকেলের গোধূলিলগ্নের আভা শাপলার বিলে যেন নতুন একটি মাত্রা যোগ করে। খুব সকালে যেতে পারলে ফুটন্ত শাপলা দেখা যায়, সকাল ১০ টার পর অর্থাৎ রোদের তীব্রতা বাড়লে শাপলা তার পাপড়ি গুটিয়ে নেয়। সন্ধ্যার পরে আবার ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে।

এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যকে দ্বিতীয়বার স্মরণ করতে চাইলে ক্যামেরায় তোলা ছবির বিকল্প নেই
স্থানীয়রা জানান, বিলগুলোতে গ্রামের প্রায় ১০০ জনের মালিকানাধীন জমি রয়েছে। আনুমানিক ৬০০ একর জমিজুড়ে সাতলা বিলের অবস্থান। প্রাকৃতিকভাবেই এ গ্রামের বড় এই বিলে যুগ যুগ ধরে অতিথি পাখির মতো ফিরে আসে শাপলা। এখানে এলেই বোঝা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর ছেলেমেয়েরা ব্যতীত অন্যরা বই-পুস্তকের মাধ্যমে শাপলা ফুলকে চিনলেও বাস্তবে শাপলার সৌন্দর্য উপভোগ ও বিল-ঝিল থেকে নিজহাতে শাপলা তোলার যে আনন্দ তা থেকে পুরোপুরিই বঞ্চিত।
জানা যায়, প্রতি বছর জৈষ্ঠ্য থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত মোট ছয় মাস এই সাতলা বিলে পানি জমে থাকে। বছরের ছয় মাস বিলে পানি জমে থাকার কারণে বিলটি এক ফসলা জমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর ধানের মৌসুমে জমিতে চাষ দেয়া হলেও মাটির সঙ্গে মিশে থাকছে শাপলা-শালুকের বীজগুলো। ফলে পরের বছরে বিলে পানি আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই বীজ থেকেই আবার শাপলার জন্ম হচ্ছে। এ সকল এলাকার হাট-বাজারগুলোতে ছোট ছোট শিশু থেকে বড়দেরও জীবিকা নির্বাহের জন্য সকাল হলেই সবজি হিসেবে শাপলাকে বিক্রি করতে দেখা যায়। শুধু শাপলাই নয়, শাপলার মূলের অংশ অর্থাৎ শালুক গ্রামাঞ্চলে সিদ্ধ করে খাওয়া হয়।
কীভাবে ঘুরবেন
লাল শাপলার রাজ্যে ঘুরতে চাইলে অবশ্যই নৌকার প্রয়োজন হবে। এ জন্য সাতলার মাঝিদের শরণাপন্ন হতে হবে। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ঘোরার জন্য আপনাকে নৌকার ব্যবস্থা করে দেবে তারা। নৌকা ও লোকজনের পরিমাণভেদে নৌকায় ভ্রমণের জন্য এ খরচের পরিমাণ ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা হতে পারে। আর ঘুরতে বেরোনোর সময় অবশ্যই সঙ্গে ক্যামেরা নিতে ভুলবেন না। কারণ, এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশকে দ্বিতীয়বার স্মরণ করতে চাইলে ক্যামেরায় তোলা ছবির বিকল্প নেই। ঘুরতে ঘুরতে শাপলার পাতার ওপর দেখা মিলতে পারে ছোট-বড় সাপের। ভয়ের কারণ নেই, এগুলো কোনো ক্ষতি করবে না। তবে সাবধানে দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়।
কোথায় থাকবেন
সাতলায় থাকার জন্য ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে স্থানীয় লোকজনের সাহায্য নিয়ে রাতযাপন করতে পারেন। এটাই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি। কারণ শাপলা দেখতে আপনাকে সকালেই যেতে হবে বিলে, ওই গ্রামে রাত কাটালে আপনার জন্য সহজতর হবে। এমনকি খাওয়া-দাওয়াও সারতে হবে এখানে। অবশ্যই আপনি তাদের অতিথিপরায়ণতায় মুগ্ধ হবেন। এছাড়া খানিক দূরত্বের হারতা বাজারে রাতে থাকার জন্য স্বল্পখরচের দুটি হোটেল আছে, তবে সেটা শহুরে লোকজনের জন্য খুব একটা আরামদায়ক হবে না। আরামদায়ক রাতযাপনের জন্য অবশ্যই উজিরপুর বা বরিশালের শরণাপন্ন হতে হবে।

এমন দৃশ্য দেখতে খুব সকালে যেতে হবে
কখন যাবেন
বিলে শাপলা জুন মাস থেকে ফোটা শুরু করে। তবে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শাপলায় ভরপুর থাকে। বছরের এই মাসগুলোতে শাপলা গ্রাম সাতলা গেলে হাজারো শাপলা দেখতে পাবেন। আর অবশ্যই খুব সকালে যেতে হবে, কারণ বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শাপলা ফুল বুজে যায়। আবার শাপলা ফুল ব্যবসায়িরা ফুল বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যায়।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার সদরঘাট থেকে রাত ৮ টা থেকে রাত ৯ টার মধ্যে সুন্দরবন ৭/৮, সুরভী ৮, পারাবত ১১, কীর্তনখোলা ১/২ লঞ্চগুলো বরিশালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আর সকালে যেতে চাইলে গ্রিনলাইন লঞ্চে যেতে পারেন। রাতে যাত্রা করা লঞ্চগুলো ভোর ৫ টার দিকে বরিশাল পৌঁছায়। এসব লঞ্চের ডেকের ভাড়া ১৫০ টাকা, ডাবল কেবিনের ভাড়া ১৬০০ টাকা এবং ভিআইপি কেবিন ভাড়া ৪৫০০ টাকা।
সড়ক পথেও যেতে পারেন। তবে সেটা সুবিধার হবে না। ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে প্রায় ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় লাগে। ঢাকার গাবতলি বাস টার্মিনাল থেকে ভোর ৬ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত নিয়মিত ভাবে বাস বরিশালের পথে যাত্রা করে। বাসগুলো সাধারণত পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে বরিশাল যায়, তবে কিছু বাস মাওয়া ঘাট পাড় হয়ে বরিশালের দিকে যায়। বাসগুলো বরিশাল শহরের নতুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ডে এসে থামে।
বরিশাল থেকে বাসে শিকারপুর এসে অটো ভাড়া করে উত্তর সাতলা যেতে পারবেন। এছাড়া ঢাকা থেকে বাসে বরিশাল যাওয়ার সময় উজিরপুরের নুতনহাট বাস থেকে নেমে সেখান থেকেও সরাসরি অটো করে সাতলা শাপলা বিল দেখতে যেতে পারবেন। কিংবা বরিশালের নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাতলা ও বাগধা গ্রামে যাওয়ার সরাসরি বাস সার্ভিসে ২ ঘণ্টায় পৌঁছে যেতে পারবেন আপনার গন্তব্যে। এছাড়াও বরিশাল থেকে মহেন্দ্র গাড়িতে চড়েও ঘুরে আসতে পারবেন শাপলা গ্রাম থেকে।সূত্রে:ডেইলি বাংলাদেশ